Channel 786 | চ্যানেল ৭৮৬ | Community Bangla Newspaper

‘বীরাঙ্গনাদের কষ্ট অবর্ণনীয়, তারা বেঁচে থাকে মৃত্যুর অপেক্ষায়’

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৩:০০, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩

‘বীরাঙ্গনাদের কষ্ট অবর্ণনীয়, তারা বেঁচে থাকে মৃত্যুর অপেক্ষায়’

সুরমা জাহিদ। বীরাঙ্গনাদের চাপা পড়া ইতিহাস যারা জনসমক্ষে তুলে এনেছেন, তিনি তার মধ্যে অগ্রগণ্য। এই কাজ করতে গিয়ে তাকে অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৭ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং এ বছর পেলেন স্বাধীনতা পদক। বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করার আদ্যোপান্ত জানিয়েছেন চ্যানেল৭৮৬-কে। সঙ্গে ছিলেন রোকাইয়া মোহনা

স্বাধীনতা পদক পাওয়ার অনুভূতি কেমন?
এটা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক। তাই এটা পাওয়ার অনুভূতিও সব অনুভূতির শীর্ষে। সত্যি কথা বলতে কী, এটা অর্জন করার অনুভূতি ঠিক বলে বুঝাতে পারবো না। এটুকু বলতে পারি, আনন্দটা সীমাহীন। আমি ভীষণ গর্ব অনুভব করছি। 

বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করার শুরুটা কীভাবে?
বীরাঙ্গনাদের নিয়ে এত বড় পরিসরে কাজ করবো, শুরুতে সেটা আমার পরিকল্পনায় ছিল না। বীরাঙ্গনা কারা আর তাদের কষ্টের বিষয়গুলো জানার জন্য এ ব্যাপারে আমি একটু কাজ শুরু করি। কয়েকজন বীরাঙ্গনার ব্যাপারে জানার পর আমার খুবই খারাপ লাগতে শুরু করে। ভেবে অবাক হচ্ছিলাম, মানুষ এত কষ্ট বয়ে নিয়ে বেড়ায় কীভাবে? তারপর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, তাদের ব্যাপারে জানবো এবং মানুষকে জানানোর চেষ্টা করবো। সেই চিন্তা থেকেই বীরাঙ্গনাদের নিয়ে বড় পরিসরে কাজ করতে শুরু করলাম। 

রক্ষণশীল সমাজে বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করা কতটা চ্যালেঞ্জের?
বীরাঙ্গনারা আসলে তাদের জীবনের এই কালো অধ্যায় নিয়ে মুখ খুলতে চায় না। অথবা চাইলে পারিপার্শিক অবস্থার কারণে তারা মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। অনেক সময় তারা বলতে চাইলেও পরিবার কথা বলতে দেয় না। সবমিলিয়ে তাদের মুখ থেকে কথা বের করে আনা অনেক কষ্টের। এটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ আমি গ্রহণ করেছি। কতটুকু উতরাতে পারলাম, সেটা পাঠক জানে।

লেখালেখি শুরু করলেন কবে থেকে?
কবিতা দিয়ে আমার লেখালেখি শুরু। এরপর গল্প লিখলাম বেশ কয়েকটা। এরপর উপন্যাস লিখলাম। সবশেষে শুরু করলাম বীরাঙ্গনাদের নিয়ে লেখালেখি। আগেই বলেছি, এটা খুব একটা সহজ কাজ নয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে হয়। রেকর্ড করতে হয়, নোট রাখতে হয়। তারপরও এখনও একটু সুযোগ পেলেই কবিতা লেখার চেষ্টা করি।

বীরাঙ্গনা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের আর কোন বিষয়ে আপনার কাজ আছে?
অনেকেই মনে করে, আমি শুধু বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করছি। ব্যাপারটা আসলে তা নয়। মুক্তিযুদ্ধের আরও বেশ কয়েকটি শাখা নিয়ে আমি কাজ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় শিশুদের অবস্থা কেমন ছিল, মানে যুদ্ধশিশুদের অবস্থা কিংবা যারা পাকিস্তানে আটকা পড়ছিলেন তারা কী অবস্থায় ছিলেন—এসব বিষয়েও আমার অনেক লেখালেখি রয়েছে।

যেসব বীরাঙ্গনাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তাদের পরিস্থিতি কেমন?
তাদের কারও জীবনই সুখকর নয়। স্বাধীনতার সময় যে কালো অধ্যায় তাদের জীবনে সূচনা হয়েছে, সেই অন্ধকার আর কখনো কাটেনি। অনেককেই পরিবার গ্রহণ করেনি। কারও দুই-তিনটা বিয়ে হয়েছে কিন্তু সংসার টেকেনি। কোনো কোনো বীরাঙ্গনার আর কখনো বাচ্চা হয়নি। এককথায় তাদের আর কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফেরা হয়নি। অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট নিয়ে তারা বেঁচে আছেন কিংবা মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি যত বীরাঙ্গনার সাক্ষাৎকার নিয়েছি, তার মধ্যে মাত্র একজনকে পেয়েছি যিনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।

বীরাঙ্গনাদের পরিবার থেকে কীভাবে বাধা সৃষ্টি করা হতো?
ওই যে জীবনানন্দের একটা কবিতা আছে না…‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’ তেমনিভাবে বীরাঙ্গনারাও ভয়ংকর সেই স্মৃতিগুলো রোমন্থন করতে চাইতেন না। পরিবারের লোকজন বলতো, কী দরকার পুরনো সেই ইতিহাস ঘাটাঘাটি করা। এতে বুড়ো বয়সে ওই নারীর আরও বেশি সম্মানহানি হবে। আমি হয়তো তার ইতিহাস জেনে চলে আসবো, তারপর সেগুলো প্রকাশ হবে। কিন্তু আমি তো তাকে সমাজের ভ্রুকুটি থেকে প্রটেকশন দিতে পারবো না। এটাই ছিল পরিবারগুলোর যুক্তি। এভাবে অনেক পরিবারের তোপের মুখেও পড়তে হয়েছে আমাকে।

এই কাজ করার ক্ষেত্রে আপনার পরিবারের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
সত্য কথা বলতে কি, শুরুতে আমার পরিবার থেকেই কেউ চায়নি যে, আমি বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করবো। তবে তারা যখন এ ব্যাপারে আমার মধ্যে একটা জেদ খেয়াল করল, তখন ধীরে ধীরে মেনে নিয়েছে। উৎসাহ যে দিয়েছে, এমনও নয়। তাদের ভাবটা ছিল অনেকটা এমন যে, ঠিক আছে করতে চাইলে করুক। তারপর আরও পরে যখন আমার লেখা নিয়ে লোকজন কথা বলা শুরু করলো, আলোচনা হতে লাগলো, তখন পরিবার থেকে আমাকে উৎসাহ দিয়েছে।

প্রথম বই বেরুনোর অভিজ্ঞতা কেমন?
২০১০ সালে আমার প্রথম বই বের হয় ‘বীরাঙ্গনাদের কথা’ নামে। এই বই বেরুনোর পর প্রশংসা তো দূরের কথা, উল্টো প্রচণ্ড সমালোচনার মুখোমুখি হলাম। অধিকাংশ মানুষ বলতে শুরু করলো, আমি কীভাবে এসব কথা লিখতে পারলাম। আমার কি বিবেক কিংবা লজ্জা বলে কিছু নেই নাকি! কিন্তু সেসব শুনেও না শোনার ভান করেছি। যে করেই হোক, বীরাঙ্গনাদের ইতিহাস তুলে ধরতে হবে—এই লক্ষ্যে আমি অটুট ছিলাম। 

তখন যারা সমালোচনা করেছিলেন, এখন তাদের অবস্থান কী?
নিশ্চয়ই ভালো। সেই মানুষগুলোই এখন আমার প্রশংসা করছে। একজনের কথা না বললেই নয়, যিনি আমাকে সবচেয়ে বেশি সমালোচনায় বিদ্ধ করেছেন। সঙ্গত কারণেই এখানে তার নাম বলা যাচ্ছে না। মনে পড়ে, আমি যখন বাংলা একাডেমি পুরস্কারটা পেলাম, তখন তিনিই আমোকে সবচেয়ে আগে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, উনি আমাকে বললো, আপনি নিশ্চয়ই স্বাধীনতা পুরস্কারও পাবেন। আজ সেটাই সত্যি হয়েছে।

আপনি কীভাবে বীরাঙ্গনাদের তথ্যগুলো সংগ্রহ করতেন?
আমি যেহেতু এ বিষয়ে পুরোদমে কাজ করছি, তাই আমার কাছে বিভিন্ন সোর্স থেকে খবর আসতো। সবচেয়ে কষ্ট হতো বীরাঙ্গনাদের ঠিকানায় যাওয়া। আজ থেকে ২০-২৫ আগের কথা বলছি। তখন এত ভালো রাস্তা ছিল না, যানবাহন ছিল না। কী যে কষ্ট করে যেতে হতো। কখনো কখনো দীর্ঘ পথ হেঁটে আবার কখনো ভ্যান গাড়িতে কিংবা গরুর গাড়িতে করে যেতে হতো। তারওপর আমি একা যেতাম না, আমার পরিবারের কেউ না কেউ আমার সঙ্গে থাকতো। ঝড়-বৃষ্টি, শীত-গরম…এসব মেনে নিয়েই আমি আমার কাজে মনোনিবেশ করেছি।

সামনে আমরা আপনার কাছ থেকে কী বই পেতে যাচ্ছি?
বীরাঙ্গনাদের ওপর করা কিছু কাজ অসমাপ্ত আছে, সেগুলো ফাইনাল করছি। এছাড়া আগামী বইমেলায় ৩টা বই আসবে বলে আশাকরি। এখনো সেগুলোর নাম ঠিক করিনি। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা একটা উপন্যাসও আছে। দেখা যাক কতটুকু করতে পারি। 

আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?
আমি শুধু বীরাঙ্গনাদের কথা তুলে ধরছি কিন্তু তাদের স্বীকৃতির ব্যাপারটা আমার হাতে নেই। বীরাঙ্গনারা যেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পায়, সেটা নিশ্চিত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। আমি অনেকের সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করছি। কিছু কাজ হয়েছে আবার কিছু হয়নি। ইতোমধ্যে অনেক বীরাঙ্গনাই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন, ভাতা পাচ্ছেন। সব বীরাঙ্গনাই যেন এই সুবিধার আওতায় আসে, সেটা নিশ্চিত করাই আমার পরিকল্পনা। দেখা যাক কতটুকু করতে পারি।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ কতটা দেখছেন?
আগের তুলনায় আগ্রহ অনেকটা বেড়েছে। আগে পত্রিকায় লেখা প্রকাশ হলে কিংবা বই বেরুলে যতটা ফোন পেতাম, এখন তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পাই। অনেকে ফোন করে বলেন, আপনার লেখা পড়ে আমার খুব কান্না পেয়েছে। আসলেই…বীরাঙ্গনাদের কাহিনি এতটা করুণ যে, পাঠকের চোখ কখন আদ্র হয়ে ওঠে তারা নিজেরাই টের পায় না। তরুণদের কাছ থেকেও অনেক ফোন পাই। তারা আমাকে উৎসাহ দেয়।


চ্যানেল ৭৮৬ এর নিউজ রুম এ যোগাযোগ করতে ই মেইল করুন এই ঠিকানায় [email protected] । আপনার পন্য বা সেবার প্রচারে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য কল করুন +1 (718) 355-9232 এই নাম্বারে।

সংবাদটি শেয়ার করুনঃ