কবি লিলি হক
মায়ার পৃথিবী ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন বরেণ্য কবি ও মুক্তিযোদ্ধা আসাদ চৌধুরী। তিনি শুধু বড় মাপের একজন সাহিত্যসাধকই ছিলেন না, ছিলেন ভালো মানুষও। চ্যানেল-৭৮৬ এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তার স্মৃতিচারণ করেছেন দেশের প্রথিতযশা আরেক কবি, চয়ন প্রকাশনের প্রকাশক লিলি হক। সঙ্গে ছিলেন রোকেয়া মোহনা।
কবি আসাদ চৌধুরী চলে গেলেন, আমাদের কতটা ক্ষতি হলো?
কবি, সাহিত্যিক পরিচয় তো আছে, তারচেয়ে বড় কথা—আমরা সত্যিকারের একজন ভালো মানুষকে হারিয়ে ফেলেছি। আমরা সবাই চলে যাবো, এটা স্বাভাবিক। তবে কবি আসাদ চৌধুরীর মতো মানুষের চলে যাওয়াটা সমাজের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। কারণ এসব মানুষের শূন্যস্থান আমরা অন্য কেউ তো কখনোই পূরণ করতে পারব না।
আসাদ চৌধুরী নাম নিয়ে একটা গল্প আছে…।
হুম…গল্পটা খুব মজার। তার মূল নামটা কিন্তু অনেক বড়। বাবা শখ করে তার নাম রেখেছিলেন আশিকি ওয়াহেদ মোহাম্মদ আসাদুল হক চৌধুরী। এই নাম নিয়ে অনেক মজা করতেন তিনি। একদিন হাসতে হাসতে বললেন, বাবা হয়তো অনেক ভাইবোনের নাম একসঙ্গে আমার ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। তার নামটা ছোট হয়ে আসার একটা গল্প আছে। কবি আসাদ চৌধুরির প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল দৈনিক সংবাদে। তখন তিনি অনেক ছোট। কবিতাটা সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়নি, আরও সম্মানের সঙ্গে সম্পাদকীয় পাতায় ছাপা হয়েছিল। লেখাটা উনি পাঠিয়েছিলেন বাবার দেওয়া নামে, কিন্তু ছাপা হলো আসাদ চৌধুরী নামে। এই নামটা পছন্দ হয়ে যায় তার। তারপর থেকে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন আসাদ চৌধুরী নামে।
কবির জন্ম ও পড়াশোনা কোথায়?
বরিশালের কীর্তনখোলার অগাধ জলরাশির মাঝে কবি আসাদ চৌধুরীর জন্ম। সেখান থেকেই তিনি মেট্রিক পাশ করলেন। ভর্তি হলেন ব্রজমোহন কলেজে। সেখান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে চলে আসলেন ঢাকায়, ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করলেন। কর্মক্ষেত্রে এসে অধ্যাপনা করলেন, সাংবাদিকতা করলেন।
তাকে ‘তবক দেওয়া পানের কবি’ বলা হয় কেন?
১৯৭৫ সালে ছাপা হলো আসার চৌধুরির প্রথম বই ‘তবক দেওয়া পান’। তিনি খুব পান খেতেন তখন। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তার বন্ধু-পরিচিতজনরা পান পাঠাতেন তার জন্য। আমরাও পান চাইলে দিতেন। কাউকে কখনো না করেননি। নিজে পান খেতেন আবার প্রথম বইয়ের নামেও পান। এসব কারণে তিনি পরিচিত হয়ে উঠলেন ‘তবক দেওয়া পানের কবি’ হিসেবে। সবচেয়ে বড় কথা, ‘তবক দেওয়া পান’ কাব্যগ্রন্থটি সে সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী?
ভীষণ মানবিক ছিলেন। মানুষের দুঃখে তার হৃদয় কাঁদতো। উনার ভেতর কোনো হিংসা ছিল না, ঈর্ষা ছিল না। তার পরিবর্তে প্রেম ছিল, ভালোবাসা ছিল। একজন আসাদ চৌধুরী যেরকম মানুষ ছিলেন, এমন মানুষ থাকলে সমাজটাই বদলে যায়, চারপাশ উজ্জ্বল হয়ে যায়।
তার জীবন থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি?
এখনকার মানুষের মধ্যে নেতিবাচক চিন্তা আর হতাশা ভরা। কবি আসাদ চৌধুরী ছিলেন সম্পূর্ণ উল্টো। তার মধ্যে কখনো কোনো নেতিবাচক চিন্তা দেখিনি, কোনো হতাশা দেখিনি। তিনি তার পুরো জীবনটাকেই শিল্পোত্তীর্ণ করেছিলেন। কাজ করে গেছেন আর জীবনকে উপভোগ করেছেন। আমি প্রায় ৪ দশক তার সংস্পর্শ পেয়েছি। এই পুরো সময়টাতে তাকে নিরন্তর ছুটতে দেখেছি। থেকে থাকেননি, বিশ্রাম নেননি। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, আমরা যেন জীবনের কোনো মুহূর্তে হতাশ না হই, যেন প্রত্যাশায় আন্দোলিত হই। তিনি আসলে সাহসের রেলিংয়ে ভর দিয়ে বেঁচেছিলেন।
আসাদ চৌধুরীর বই পড়া কতটা জরুরি?
ভীষণ জরুরি। এত বড় একজন কবির বই না পড়লে তাকে তো জানা অসম্ভব। তরুণ প্রজন্মকে অনুরোধ করবো আসাদ ভাইয়ের লেখা পড়ার জন্য। একজন আসাদ চৌধুরীকে ভালোভাবে বুঝতে হলে তাকে ভালোভাবে পাঠ করতে হবে। শুধু কবিতা নয়, তার সব লেখা। তিনি একজন সাহিত্যসাধক তো বটেই, সততার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও। অসাধারণ মেধাবী ছিলেন তিনি। দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, কবিতা, নাটক—যে বিষয়েই তাকে বলা হতো, অনর্গল লেকচার দিয়ে যেতেন। আমরা বিস্ময়ে হা করে তাকিয়ে থাকতাম।
জীবদ্দশায় কী কী স্বীকৃতি পেলেন তিনি?
১৯৭৫ সালে আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছিলেন আসাদ ভাই। আমরা তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলাম। তারপর তিনি অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার পেলেন ১৯৮২ সালে। আর বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেন ১৯৮৭ সালে। একুশে পদক পেলেন ২০১৩ সালে। অবশ্য এসব পুরস্কার নিয়ে তিনি মাথা ঘামাতেন না, নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের কাজটা করে যেতেন।
চয়নের সঙ্গে কবি আসাদ চৌধুরীর সম্পর্ক কেমন ছিল?
চয়নের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। বাসায় আমরা ঘরোয়াভাবে যে মাসিক সাহিত্য আড্ডা করে থাকি, সেখানেও আসাদ ভাই এসেছেন অনেকবার। বেশ মজা করতেন। তার একটা দক্ষতা ছিল, একজন নতুন মানুষের সঙ্গে অনায়াসেই মিশে যেতে পারতেন। আমাদের চয়ন পত্রিকায় নিয়মিত লেখা দিতেন। যখনই লেখা চাইতাম, কোনোদিন না করেননি।
উর্দু কবিতা অনুবাদ করেছিলেন তিনি…।
হুম। ‘বাংলাদেশের উর্দু কবিতা’ নামে তার একটা বই আছে। এই কবিতার বই বেরুনোর পর আমরা অবাক হয়ে গেলাম। একজন বাঙালি ছেলে অনুবাদ করল উর্দু কবিতা। আসলে জ্ঞানের এক সাগর ছিলেন আসাদ চৌধুরী। ভাষার এক মহাপণ্ডিত ছিলেন। আমাদের জন্য পরম সৌভাগ্য এই যে, বাংলাদেশে আমরা এমন একজন সাহিত্যসাধক পেয়েছিলাম। সাহিত্যের সকল শাখায় তিনি যেমন লিখেছেন, তেমনি বলতে পারতেন দারুণ।
তিনি সুখী মানুষ ছিলেন নিশ্চয়ই…?
অবশ্যই। তিনি প্রাপ্তির সুখে বিভোর ছিলেন। আনন্দের মধ্যেই পুরো জীবনটা উদযাপন করে গেছেন। কী পেলেন আর কী পেলেন না, সেটা নিয়ে তাকে কোনোদিন ভাবতে দেখিনি। উল্টো তিনি আমাদেরকে একটা জীবন দিয়ে গেছেন। আমরা সত্যিই এক প্রাজ্ঞজনের প্রোট্রেট হারিয়ে ফেলেছি। একজন মহান শিল্পীকে হারিয়েছি। একজন মমতাময়ী কবিকে হারিয়েছি। এই হারানোটা খুব ক্ষতিকর এই জন্য যে, সাহিত্যে আসাদ চৌধুরীর আরও অনেক কিছু দেওয়ার বাকি ছিল।
চ্যানেল৭৮৬ এর নিউজ রুমে যোগাযোগ করতে ইমেইল করুন এই ঠিকানায়[email protected] । আপনার পণ্য বা সেবার প্রচারে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য কল করুন +1 (718) 355-9232 এই নম্বরে।