Channel 786 | চ্যানেল ৭৮৬ | Community Bangla Newspaper

‘বাঙালিকে চিরকাল রবীন্দ্রনাথের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে’

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৮:০১, ৯ আগস্ট ২০২৩

‘বাঙালিকে চিরকাল রবীন্দ্রনাথের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে’

সম্প্রতি গত হয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮২তম প্রয়াণ দিবস। বাঙালি জাতির অন্যতম এই মহান পুরুষ ৮০ বছরের এক বর্ণাঢ্য জীবন অতিক্রম করেছেন। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির কোথায় নেই রবীন্দ্রনাথ? তার বিশাল কর্মময় জীবন নিয়ে চ্যানেল-৭৮৬ এর সঙ্গে কথা বলেছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম

এক জীবনে অনেক কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আপনার দৃষ্টিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনটি?
বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সবগুলো শাখাতেই কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সার্বিকভাবে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো—আজকে আমরা যে প্রমীত আধুনিক বাংলায় কথা বলি, এই ভাষাটি রবীন্দ্রনাথের নির্মাণ। আমাদের যে প্রাচীন বাংলা, তিনি সেটিকে সংস্কার করে মানুষের মুখের কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন। এটা করেছেন ভাষার কৌলিন্য ঠিক রেখেই। গদ্যে, পদ্যে এবং গীত রচনা-এই ত্রি ধারাতেই সংস্কার করেছেন। এজন্য বাঙালিকে চিরকাল রবীন্দ্রনাথের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। আর উত্তর প্রজন্মের আমরা যারা লেখালেখি করি, তাদের কাছে তিনি তো প্রণম্য।

বাংলা সাহিত্যে তার অবদান কতটুকু?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মুশকিল। বাংলা সাহিত্যে তার অবদান তো বিশাল। তার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৫২। তিনি ৩৮টি কালজয়ী নাটক লিখেছেন। উপন্যাস লিখেছেন ১৩টি। বিভিন্ন গবেষণা আর প্রবন্ধ মিলে বই বেরিয়েছে ৩৬টি। অনেক ছোট গল্প লিখেছেন, এর সংখ্যা ৯৫ কিংবা ৯৬। এসব প্রত্যেকটি কাজ কালজয়ী।

সংগীতজ্ঞ রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষকে আমি মূল্যায়ন করতে পারি না, সামান্য আলোচনা করতে পারি। আমি মনে করি, তার সবচেয়ে বড় কীর্তি হলো গান। তিনি নিজে একজন সংগীতজ্ঞ—সুর করেছেন, গেয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন প্রতিভা আসলে বিরল। সবকিছু বাদ দিলে শুধু সংগীতের জন্যই তিনি পৃথিবীতে অমর হয়ে থাকবেন। কবিগুরুর গানের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। বিভিন্ন উৎসব-পার্বনে তার গান না হলে তো আমাদের চলেই না।

বিশ্বকবির পত্রসাহিত্য নিয়েও তো প্রচুর আলোচনা হয়…
পৃথিবীর কোনো কবি-সাহিত্যিক সম্ভবত এত চিঠি লেখেননি, যতটা লিখেছেন রীবন্দ্রনাথ। তার পত্রসাহিত্যের কথা বলাই বাহুল্য। তিনি প্রচুর চিঠি লিখেছেন, অসংখ্য মানুষকে চিঠি লিখেছেন, সবার চিঠির উত্তর দিতেন। কোনো তরুণ লেখক যদি তার হাতে একটা বই তুলে দিতো, সেটা পড়েও তিনি মন্তব্য করতেন, ওই লেখককে চিঠি লিখতেন। রবীন্দ্রনাথের বিশাল এই পত্রসাহিত্য বেরিয়েছে ১৯ খণ্ডে। 

রবীন্দ্রনাথের কোন দিকটি নিয়ে আলোচনা কম হয় বলে মনে করেন?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন বড় মাপের চিত্রশিল্পী, বোধকরি এটা অনেকে জানেনই না। তিনি অনেক ছবি আঁকতেন। অসাধারণ সেসব ছবি। সবমিলিয়ে ২ হাজার ছবি এঁকেছেন, ভাবা যায়! রবীন্দ্রনাথ আসলে বিস্ময়কর প্রতিভার একজন মানুষ।

সাহিত্যের এমন কোনো শাখা আছে, যেখানে রবীন্দ্রনাথ নেই?
প্রশ্নই ওঠে না। সাহিত্যের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথ হাত দেননি। এই মহান সাহিত্যিকের পরবর্তীকালে লেখকরা তো অনেকদিন যাবত রবীন্দ্রনাথকেই লিখে গেছেন। আমি সত্তরের দশকের এক কবিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নতুন কিছু লেখেন না কেন? তিনি বলেছিলেন, নতুন কী আর লিখবো, সব তো রবীন্দ্রনাথ লিখে ফেলেছেন! 

পরবর্তীতে কোনো কোনো লেখক রবীন্দ্রবলয়কে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন-কথাটা কতটুকু সত্য?
রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের বিশাল একটি ধারা তৈরি করেছেন, বলা যায় বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগটা তারই নির্মাণ। তারপরও তার জীবদ্দশাতেই এই ধারাকে অস্বীকার করেছেন আমাদের ত্রিশের দশকের লেখকেরা। করেছেন এজন্য যে, রবীন্দ্রনাথ এত বড় বটবৃক্ষ, তার ছায়ায় দাঁড়িয়ে তার ধারায় লেখালেখি করে কোনোভাবেই তাকে ছাপিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তাই স্বাতন্ত্র্য তৈরি করতে না পারলে কোনো লেখক দাঁড়াতে পারবে না। ত্রিশের দশকের লেখকেরা এটা বুঝেছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথকে প্রত্যাখানই করেছিলেন।

তারা কি সফল হয়েছিলেন?
আসলে চাইলেই তো আর রবীন্দ্রনাথকে প্রত্যাখান করা যায় না। বহুকাল রবীন্দ্রনাথের ওপরই তাদেরকে পড়ে থাকতে হয়েছে। হয়তো তারা আঙ্গিকগত কিছুটা পরিবর্তন এনেছেন, এর বেশি কিছু নয়। তারা হয়তো অন্তমিল বর্জন করেছেন, ছন্দ কিছুটা ভেঙে দিয়েছেন, কবিতায় বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয় আরোপ করেছেন, ক্রিয়াপদের ফর্মকে সাধু থেকে চলতিতে নিয়ে এসেছেন; কিন্তু বিষয়বস্তুর খুব একটা পরিবর্তন সাধন করতে পারেননি। তাই আমি বলবো, রবীন্দ্রনাথকে আমরা অতিক্রম করে খুব বেশিদূর যেতে পারিনি।

রবীন্দ্রনাথের কাজগুলো প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে কী করা দরকার?
সেটা নিয়ে তো প্রচুর কাজ হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে তো বিশ্বভারতী আছেই, তারা দিনরাত এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশেও বিভিন্নভাবে কাজ হচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে। আড্ডা হচ্ছে, সভা-সেমিনার হচ্ছে। সাহিত্য সমাজে যারা প্রতিনিধিত্ব করছেন, তাদেরকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে।

রবীন্দ্রনাথের এই বিশাল কর্মযজ্ঞের কতটা অনুবাদ হয়েছে?
বলা যায়, রবীন্দ্রসাহিত্যের অনেক কিছুই ইংরেজীতে অনুদিত হয়েছে। সে কারণে পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষ রবীন্দ্রনাথকে চেনে, তাল লেখা পড়ে। শুধু ইংরেজি না, বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। আমি একটা আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করি, সেই সুবাধে পৃথিবীর বহু দেশের মানুষের সঙ্গে আমার সাহিত্য নিয়ে আলাপ হয়েছে। আমার অনেক সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ পড়ানো হতো। তাদের পাঠ্যপুস্তকে বেশ ভালোভাবেই জায়গা করে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। লাতিন আমেরিকারও কোনো কোনো দেশে রবীন্দ্রনাথ পড়ানো হতো।

আমাদের রবীন্দ্রচর্চার গলদ কোথায়?
আমাদের দেশে যখন কোনো উৎসব আসে, পার্বন আসে তখন আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছে হাত পাতি। তার কবিতা আবৃতি করি, গান শুনি, অন্যকে শোনাই। এরপর আর খুব একটা তার লেখা পড়তে চাই না, তার গান গাইতে চাই না। এটা দুঃখজনক। 

বলা হয়, রবীন্দ্রনাথ সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মেছেন…
এটা সত্য এবং এ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করারও কিছু নেই। তবে তিনি ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। সেই মেধাকে তিনি পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পেরেছেন। এটি খুব কম মানুষের ভাগ্যে জোটে। তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে বিশাল জমিদারি পেয়েছিলেন, যদিও কিছুকাল পরেই জমিদারি বিলুপ্ত হয়ে যায়। সংসার চালানোর জন্য উপমহাদেশের লেখকদের যে সংগ্রাম করতে হয়, সেটা করতে হয়নি রবী ঠাকুরকে। তিনি যা করতে চেয়েছেন, সেটা ঠিকঠাকভাবে করতে পেরেছেন। সারাজীবন লিখতে চেয়েছেন এবং লিখতে পেরেছেন। তার একাধিক সহকারী-সহযোগী ছিলেন, যারা ডিকটেশন দিয়েছেন। এ কারণে তার লেখার ভাণ্ডারটা বিশাল।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার পিতামাতার ১৪তম সন্তান। এখন আমরা যারা ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের কথা বলি, একটা বা দুইটা সন্তানের কথা বলি, রবীন্দ্রনাথের পিতামাতা সেটা মানতে গেলে আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মানুষ পেতাম না। ভারতবর্ষে অধিক সন্তান নেওয়ার একটি সুফল নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সেটা হবে রবীন্দ্রনাথের জন্ম!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খামতি কোথায়?
ভারতীয় উপমহাদেশে যেখানে ৪৫ কোটি মুসলমানের বাস, সেই বৃহৎ অংশটা রবীন্দ্রনাথের মতো বড় মানুষের কাছ থেকে খুব একটা কিছু পায়নি। যে কারণে পুঁজো কিংবা নববর্ষে আমরা রীবন্দ্রনাথকে পাই, কিন্তু মুসলমানদের যখন কোনো ধর্মীয় উৎসব হয়—শবে বরাত হতে পারে, ঈদ হতে পারে, শবে কদর হতে পারে, এসব উৎসবগুলোতে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে কিছু পাই না। তখন আমাদেরকে যেতে হয় কাজী নজরুল ইসলামের কাছে।


চ্যানেল ৭৮৬ এর নিউজ রুম এ যোগাযোগ করতে ই মেইল করুন এই ঠিকানায় [email protected] । আপনার পন্য বা সেবার প্রচারে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য কল করুন +1 (718) 355-9232 এই নাম্বারে।

সংবাদটি শেয়ার করুনঃ