Channel 786 | চ্যানেল ৭৮৬ | Community Bangla Newspaper

‘আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দেন প্রফেসর নাজমা চৌধুরী’

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

প্রকাশিত: ২২:৩৯, ১৩ আগস্ট ২০২১

আপডেট: ২১:০১, ১৪ আগস্ট ২০২১

‘আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দেন প্রফেসর নাজমা চৌধুরী’

করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর ড. নাজমা চৌধুরী গত ৮ আগস্ট ইন্তেকাল করেছেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফিরদৌস নসীব করুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর মত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন শিক্ষক কমই পেয়েছি। মফ:স্বলের ছোট শহর থেকে আগত আমার চোখে তিনি তাকিয়ে থাকার মত সুন্দরী।

তখন তাঁর বয়স ৩৩/৩৪ বছর। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর। তাঁর সার্বক্ষণিক গাম্ভীর্য সত্ত্বেও তিনি ছাত্রছাত্রীদের অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। আমারও খুব পছন্দের শিক্ষক তিনি। সামনে পড়লে একপাশে সরে মাথা নিচু করে সালাম দিতাম, স্মিত হেসে তিনি সালামের উত্তর দিতেন। আমার প্রিয় শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও আমি কখনও তাঁর ক্লাসে এটেন্ড করিনি।

আমাদের সময়ে অনার্স পরীক্ষা দিতে হতো প্রতিটি ১০০ নম্বর করে আটটি পেপারের। বিপত্তি ঘটলো অনার্স পরীক্ষার আগে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে আমাদের ব্যাচের দুটি সেকশন ছিল। আমার ক্লাসমেট ও এসএম হলে আমার রুমমেট আবু তাহের ভাই (মরহুম) ও আমার সেকশন আলাদা হয়ে যায়। ফার্ষ্ট ইয়ার থেকে আমরা দু’জন একই সেকশনে পাশাপাশি বসে ক্লাস করতাম। থার্ড ইয়ারে একটি পেপারে আমাদের দু’জনের সেকশন আলাদা হওয়ার পরও আমি তাহের ভাইয়ের সেকশনে ক্লাস করছিলাম। উনার সেকশনের শিক্ষক প্রফেসর শামসুল হুদা হারুন, আমার সেকশনের শিক্ষক প্রফেসর নাজমা চৌধুরী।

একদিন হঠাৎ শুনলাম ক্লাসে ৬০% উপস্থিত না থাকলে অনার্স পরীক্ষায় বসার জন্য ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হবে না। আমি তো নাজমা চৌধুরীর একটি ক্লাসেও যাইনি। এ সংক্রান্ত নোটিশও বোর্ডে টানানো হয়েছে, যা আমি লক্ষ্যও করিনি। অতএব বাধ্য হয়েই আমি নাজমা চৌধুরীর ক্লাসে হাজির হলাম। তিনি রোল কল করার সময় আমি ওঠে ‘ইয়েস ম্যাডাম’ বলে ওঠে দাঁঁড়ালাম। নাজমা চৌধুরী আমার দিকে তাকালেন। উনি আগে কখনও আমাকে ক্লাসে দেখেননি।

হাজিরা খাতায় আমি বরাবর অনুপস্থিত। জানতে চাইলেন, “আমি তো আগে কখনও তোমাকে দেখিনি!” অজুহাত দেওয়ার অভ্যাস নেই আমার। তাঁকে বললাম, ‘ম্যাডাম, আমি এই পেপারে শামসুল হুদা স্যারের ক্লাস করছি।’ তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, কিন্তু আজ এসেছো কেন? উত্তম দিলাম, ক্লাসে ৬০% উপস্থিত না থাকলে পরীক্ষার জন্য ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হবে না জানার পর আপনার ক্লাসে এসেছি। 

সম্ভবত তিনি মনক্ষুন্ন হয়েছিলেন অথবা রাগান্বিতও হয়ে থাকবেন। কিন্তু তাঁর সুন্দর মুখ দেখে বোঝার উপায় ছিল না। তবে বললেন, ওহ, তুমি আমার ক্লাস করতে আসোনি, পারসেন্টেজের জন্য এসেছো! আমি মাথা চুলকে মিন মিন করে বললাম, “জি ম্যাডাম।” তিনি বললেন, “আমার ক্লাস যেহেতু তোমার ভালো লাগে না, অতএব আমার ক্লাসে তোমার আসার প্রয়োজন নেই।”

আমার অবস্থা দেখে বন্ধুদের দু’একজন ওঠে দাঁড়ালো। টাঙ্গাইলের আবুল হোসেন ভাই বললেন, “ম্যাডাম, উনি খুব ভালো মানুষ, আমাদের সঙ্গে থাকতে দিন।” কিন্তু নাজমা ম্যাডাম তার কথায় কোনো আমল দিলেন না। আমাকে বললেন, “তুমি চলে যাও, আমার ক্লাস যেহেতু তোমার ভালো লাগে না, অতএব আমার ক্লাসে তোমার আসার কোনো প্রয়োজন নেই।”

আমি বললাম, “ম্যাডাম, আজকের ক্লাসটা করি?” তিনি নির্বিকার, “না, আজকের ক্লাসও নয়। তুমি যেখানে ক্লাস করছো, সেখানেই করো। আমি পারসেন্টেজ দিয়ে দেব,” বলে তিনি আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দেন। আমি ভয়ে ছিলাম, ফরম পূরণের আগে তাঁর কাছে গিয়ে অনুরোধ করতে হয় কিনা। কিন্তু আমাকে তাঁর কাছে আর যেতে হয়নি। তিনি নিজে থেকেই ক্লিয়ারেন্স দিয়েছিলেন।

ছাত্রজীবনের কোনো পর্যায়েই কোনো শিক্ষক কর্তৃক আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। প্রফেসর নাজমা চৌধুরী আমাকে সবার সামনে ক্লাস থেকে বের করে দেওয়ায়, আমি অপমানিত বোধ করিনি। তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধও হইনি। কলাভবনের করিডোরে, বিভাগীয় অফিসের সামনে অথবা ক্যাম্পাসের বাইরে যখনই তিনি সামনে পড়েছেন, বিনয়ের সঙ্গে তাঁকে সালাম দিয়েছি। আমার কাছে ঘটনাটি মধুর স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে।

প্রফেসর নাজমা চৌধুরী অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসার পর তাঁর সম্পর্কে কোনো ভালো খবর শুনলে আনন্দিত হয়েছি। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম নারী উপদেষ্টা হিসেবে তিনি নিয়োগ লাভ করেন। ২০০৮ সালে তিনি রাষ্ট্রীয় একুশে পদক লাভ করেন।

তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন (১৯৮৪-৮৭) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ওম্যান এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ’ প্রতিষ্ঠা করেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমিরেটাস ছিলেন। তাঁর স্বামী মাইনুর রেজা চৌধুরী বাংলাদেশের দ্বাদশ প্রধান বিচারপতি (জুন ২০০২-জুন ২০০৩) ছিলেন।

আমি আমার প্রিয় শিক্ষকের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।


চ্যানেল ৭৮৬ এর নিউজ রুম এ যোগাযোগ করতে ই মেইল করুন এই ঠিকানায় [email protected] । আপনার পন্য বা সেবার প্রচারে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য কল করুন +1 (718) 355-9232 এই নাম্বারে।

সংবাদটি শেয়ার করুনঃ