Channel 786 | চ্যানেল ৭৮৬ | Community Bangla Newspaper

আত্মত্যাগের কোরবানি ও কোরবানি ব্যবস্থাপনা

মুহসিন মাশকুর

প্রকাশিত: ০০:০১, ১৯ জুলাই ২০২১

আত্মত্যাগের কোরবানি ও কোরবানি ব্যবস্থাপনা

কোরবানি ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় একটি বিশেষ আবেগের নাম। নিজের প্রিয় জিনিসকে উৎসর্গ করে আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছাকে নিজের ইচ্ছের উপর প্রাধান্য দেয়ার নামই হলো কোরবানি। কোরবানি বা কুরবান অথবা আদ্বহা বা আযহা ইসলামে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। মনে করা হয় কোরবানি শব্দটি হিব্রু কোরবান আর সিরিয়াক ভাষার কুরবানা শব্দ দুটির সংগে সম্পর্কিত, যার আরবী অর্থ ‘কারো নিকটবর্তী হওয়া’। 

এরশাদ হয়েছে- ‘হে আমার প্রিয় পুত্র! নিঃসন্দেহ আমি স্বপ্নে দেখলাম যে আমি তোমাকে কোরবানি করছি। এখন বলো, এ ব্যাপারে তোমার মত কী? তিনিবললেন, হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। ইন-শা-আল্লাহ! আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের একজন হিসেবেই পাবেন।’ (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০২)। 

অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘মনে রেখো, এ ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে সুযোগ দিলাম এক মহান কোরবানির। পুরো বিষয়টি স্মরণীয় করে রাখলাম প্রজন্মের পর প্রজন্মে। ইব্রাহীমের প্রতি সালাম। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করি। (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০৬-১১০)। আরেকটি আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের জন্যেই নামাজ পড় ও কোরবানি কর। নিশ্চয়ই তোমার প্রতি যেই বিদ্বেষ পোষণ করবে, বিলুপ্ত হবে তার বংশধারা। (সূরা কাওসার, আয়াত ১০৮)।
 
ইসলামী মতে কোরবানি হচ্ছে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট ব্যক্তির আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও পুরস্কার লাভের আশায় নির্দিষ্ট পশু জবাই করা। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নিজ পুত্র ইসমাঈলকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানির যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন, তা-ই আমাদের জন্য প্রতিকী এই পশু উৎসর্গ। মানুষকে প্রতীকী পশু উৎসর্গ করে মূলত তার মনের যে পশু আছে তাকে কোরবানি করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

নিজের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছের উপর আল্লার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়ার অপর নামই হলো কোরবানি। এই কোরবানির ক্ষেত্রে পশুর আকার, দাম, রং, জাত এগুলো আল্লাহ্ তায়ালার কাছে কোন বিবেচ্য বিষয়ই নয়। বরং এই পশু কোরবানির মাধ্যমে মানুষ নিজেকে আল্লাহ তায়ালার জন্য উৎসর্গ করে দিতে যে প্রস্তুত এই স্বীকৃতিই আল্লাহ চান মানুষের কাছ থেকে। দৈনন্দিন জীবনে কাজের মধ্য দিয়ে মানুষ আল্লাহকে মানবে, এটাই আল্লাহ্ তায়ালা কোরবানির মাধ্যমে শেখাতে চান। মানুষ‘তাকওয়া’তথা আল্লাহ্র ভয় শিখবে ও আল্লাহ্র হুকুমের মধ্যে নিজেকে সঁপে দিয়ে আল্লাহর ইচ্ছায় নিজেকে কুরবান করে দিবে। এই জন্যই কোরবানির পশুর ক্ষেত্রে তার আকার, দাম, রং, জাত এগুলো আল্লাহ্র কাছে কোন বিবেচ্য বিষয়ই নয়। বরং আল্লাহ্র কাছে বিবেচ্য হলো মানুষের‘তাকওয়া’তথা আল্লাহ্র ভয়। 

এরশাদ হয়েছে- “এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা কর এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন”। (সূরা হজ্ব/২২:৩৭)। 

কোরবানি ব্যবস্থাপনাঃ
প্রতিবছর২ মিলিয়নের ও বেশী মানুষ পবিত্র হজ্বব্রত পালন করতে যান এবং হজ্ব উপলক্ষে মক্কা শরীফে ১.২ মিলিয়নেরও বেশী গবাদিপশু; যেমন ভেড়া, ছাগল, দুম্বা এবং উট জবাই করা হয়। ইসলামিক আইন ও জনস্বাস্থ্যের নির্দেশিকা মেনে গবাদি পশুগুলোকে কোরবানি ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য কোরবানির সময় মক্কায় স্থাপিত স্লটারিং হাউজেপ্রায় ১৬ হাজারেরও বেশী কর্মচারী ২৪ ঘন্টা কাজ করে থাকে।মক্কায় ইসলামিক আইন ও জনস্বাস্থ্যের নির্দেশিকা মেনে গবাদি পশুগুলোকে কোরবানি ও প্রক্রিয়াজাতকরণের যে প্রক্রিয়া তাতে পরিচ্ছন্নতার যে শিক্ষা ইসলাম আমাদেরকে দেয় তা প্রতিফলিত হয়।এই পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিপালনীয়। 

কোরবানি একটি বিশেষ আমল। এর মাধ্যমে মুমিন জীবনে প্রতীকী পশু কোরবানির মাধ্যমে নিজের সকল ইচ্ছার ওপর আল্লাহ্ তায়ালার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়ার শিক্ষা প্রতিফলিত হয়। পরিছন্নতা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইসলামে তেমনি গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল যেমন গুরুত্বপূর্ণ কোরবানি।বছরে মাত্র একবার কোরবানির আমল থাকলেও সারা বছর জুড়ে কিন্তু একজন মুমিনের জন্য পরিচ্ছন্নতা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আমল জরুরী।

ইরশাদ হয়েছে-‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদের।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২২২)। হাদিসেও বিভিন্নভাবে পরিচ্ছন্নতার গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে এবং এ বিষয়ে নানাবিধ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এমনকি পরিচ্ছন্নতা রক্ষাকে ঈমানের অংশ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হযরত আবু মালেক আশআ’রী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধেক।’ (মুসলিম, হাদিস নং: ২২৩)। 

সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্রতাকে পছন্দ করেন; আল্লাহ পরিচ্ছন্ন, তিনি পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করেন; আল্লাহ মহৎ, তিনি মহত্ত্ব পছন্দ করেন; আল্লাহ বদান্য, তিনি বদান্যতা পছন্দ করেন। অতএব তোমরা তোমাদের (ঘরের) উঠোনগুলো পরিচ্ছন্ন রাখবে।’ (তিরমিযী: ২৭৯৯)।
 
 ক. কোরবানি ব্যবস্থাপনায় পরিচ্ছন্নতা, দায়িত্বশীলতা ও সচেতনতাঃ 
ঈদুল আযহা বা কুরবানি ঈদে খাবার-দাবারের প্রাচুর্য যেমন থাকে, তেমনি কোরবানি পশুর বর্জ্য ও ময়লা-আবর্জনাও বাড়ে পাল্লা দিয়ে। আমরা অধিকাংশ মানুষই পশু কোরবানির জন্য যতটা আবেগী পরিচ্ছন্নতার জন্য কিন্তু ততটা আগ্রহী না। তাই কোরবানি ব্যবস্থাপনায় বিশেষ কোনো সতর্কতা আমরা অবলম্বন করি না। 

এ জন্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনানা বুঝে নিজের কোরবানিকৃত পশুর বর্জ্যও কোনো রকমে ফেলে চলে আসি। অথচ এজন্য প্রত্যেকের সচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতা জ্ঞান থাকার পাশাপাশি এ কথা বুঝতে হবে যে, কোরবানি যেমন গুরুত্বপূর্ণ আমলতেমনি কোরবানি পরবর্তী পরিচ্ছন্নতার আমলের গুরুত্বও কোন অংশে কম নয়। এখানে নিজ নিজ এলাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি নাগরিক হিসেবে সর্বোপরি মুসলিম হিসেবে সবার কিছু দায়-দায়িত্ব আছে।

হযরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রতিটি মানুষই দায়িত্বশীল, সুতরাং প্রত্যেকেই অবশ্যই তার অধীনস্থদের দায়িত্বশীলতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। দেশের শাসক জনগণের দায়িত্বশীল, সে তার দায়িত্বশীলতা ব্যাপারে জবাবদিহী করবে। একজন পুরুষ তার পরিবারের দায়িত্বশীল, অতএব সে তার দায়িত্বশীলতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার স্বামী ও সন্তানের দায়িত্বশীল, কাজেই সে তার দায়িত্বশীলতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। অতএব প্রত্যেকেই নিজ নিজ অধীনস্থের দায়িত্বশীলতার ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’ [বুখারি, ৮৯৩, মুসলিম ১৮২৯, তিরমিযি ১৭০৫, আবু দাউদ ২৯২৮, আহমদ ৪৪৮১]

আশেপাশের পরিবেশ সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য সংশ্লিষ্টদের কিছু বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। যেমন-পশুর হাটের বর্জ্য মাটি চাপা দিতে হবে ও কোরবানি পশুর কোনো বর্জ্যই নর্দমা, নালা, ড্রেন এসব জায়গায় ফেলা যাবে না।
কোরবানির পর পশুর রক্ত ও বর্জ্য যত্রতত্রপড়ে থাকতে দেখা যায়। এগুলো খোলা স্থানে ফেলে রাখা একেবারেই উচিত নয়। গর্ত করে তা অতি দ্রুতপুঁতে ফেলতে হবে। রক্ত ও নাড়িভুঁড়ি যেহেতু খুব অল্প সময়ে দুর্গন্ধ ছড়ায় তাই তা যত দ্রুত সম্ভব মাটি চাপা দিতে হবে। আবার মাটি থেকে সরানো সম্ভব না হলে পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে। অন্যথায় জীবাণু জন্মে তা থেকে নানা রোগ ছড়াতে পারে।

কোরবানির সময় পরিবেশের পাশাপাশি স্বাস্থ্যের প্রতিও বিশেষ খেয়াল রেখে গোশত খাওয়া জরুরী। নিতান্তই খুব অল্প পরিমাণে খেতে হবে যাতে ডায়বেটিস, ব্লাড প্রেশার বেড়ে না যায়। কোরবানি গোশতের পাশাপাশি প্রতিদিন কিছু শাক-সবজি খেতে হবে। স্বাস্থ্য সচেতনতা ইসলামের শিক্ষা। তাই সকল ক্ষেত্রেই সচেতনতা জরুরী। আল্লাহ আমাদেরকে সুস্থ থাকার জন্যসচেতন থাকতে বলেছেন।আমরা জানি যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যক্তিগত জীবনে খুব স্বাস্থ্য সচেতন ছিলেন এবং নিরোগ ও সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন।   
 
খ. কোরবানিরপশু নির্বাচনঃ
কোরবানি সঠিক হওয়ার পূর্বশর্ত হলো কোরবানিরপশুসুস্থ, রোগও বড় ধরণেরখূঁতমুক্ত হওয়া। যে পশুই কোরবানি দেয়া হোক না কেন তা হতে হবে সুস্থ ও সবল। কোরবানির পশু চয়নের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, এই পশুটি আল্লাহর দরবারে উপহার দেয়া হচ্ছে। তাই উৎকৃষ্ট পশু উপহার দেয়া উচিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকোরবানির পশুর চোখ ও কান ভালোভাবে দেখে নেয়ার কথা বলেছেন। যাতে চোখ ও কানে কোনো ধরনের খুঁত না থাকে। 

এ সম্পর্কে হজরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনায় একাধিক হাদিস এসেছে- হজরত হুজাইয়্যা বিন আদি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, আমি হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলতে শুনেছি, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে আদেশ করেছেন, আমরা যেন কুরবানির পশুর চোখ ও কান উত্তমরূপে দেখেনিই।’ (নাসাঈ)।

প্রতি বছর ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্য ও অনন্দ মুখর পরিবেশে পবিত্র কোরবানির ঈদ ও পশু কোরবানি করা হয়। করোনা ভাইরাস শুধুমাত্র আমাদেরকেই নয় বরং পুরো বিশ্ববাসীকে একটি কঠিন সত্যের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে।মানুষ যে এত এত শক্তি-সামর্থ্যের বড়াই করে আল্লাহর একটি ছোট ভাইরাসের সামনে সেগুলো কিছুই নয়। তাই সময় এসেছে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করার। সময় এসেছে নিজেদের কৃতকর্মের হিসেব নেয়ার। কোরবানির শিক্ষা আমাদেরকে সত্যিকারের তাকওয়া তথা খোদাভীতি অর্জন করে আল্লাহ্র দিকে ফেরার সুযোগ করে দিক। কোরবানির আত্মত্যাগের মহীমায় জেগে উঠুক মুমিনদের প্রাণ।পৃথিবীর সকল মানুষকে এই কোরবানির উসিলায় আল্লাহ্ করোনা ভাইরাসের মহামারী থেকে হেফাজত করুন। 

লেখক: গবেষক, খতীব ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক


চ্যানেল ৭৮৬ এর নিউজ রুম এ যোগাযোগ করতে ই মেইল করুন এই ঠিকানায় [email protected] । আপনার পণ্য বা সেবার প্রচারে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য কল করুন +1 (718) 355-9232 এই নাম্বারে।

সংবাদটি শেয়ার করুনঃ