Channel 786 | চ্যানেল ৭৮৬ | Community Bangla Newspaper

শবে বরাত নিয়ে মতভেদ কেন?

মাহমুদ আহমদ

প্রকাশিত: ১৮:৪৪, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

শবে বরাত নিয়ে মতভেদ কেন?

শবে বরাত নিয়ে মুসলিম উম্মাহর মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। এ রাত সম্পর্কে একপক্ষের মত হল, এ রাতে প্রত্যেক মানুষের ভাগ্য লিখে দেয়া হয়। তাই এ রাতে অনেক বেশি নামাজ পড়ে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে হয়। এক পক্ষ এর বিরোধিতা করে থাকে।

যারা শবে বরাত পালন করেন, তারা এর পক্ষে পবিত্র কুরআনের সুরা দুখানের ৩-৫ নম্বর আয়াত উপস্থাপন করে থাকেন। যেখানে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন- ‘আমি একে নিশ্চয় এক আশিষপূর্ণ রাতে অবতীর্ণ করেছি, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নিশ্চয় আমিই রাসুল প্রেরণ করে থাকি।’

তারা কিছু হাদিসও উপস্থাপন করে থাকেন।

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ সা. নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সেজদা করলেন যে আমার ধারণা হলো, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা! তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে? আমি উত্তরে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ সা.! আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না? নবীজি সা. বললেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলই ভালো জানেন। তখন নবীজি সা. বললেন, এটা হলো অর্ধশাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন; ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন। (শুআবুল ইমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৮২)।

কিছু লোকের মতে, দ্বিতীয় হিজরিতে কিবলা পরিবর্তন হয়। আর সে দিনটি ছিল ১৫ই শাবান। এ জন্য এ দিনটি উদযাপন করা হয়। অনেক আলেম শবে বরাতকে সুরা দুখানের আয়াতে বর্ণিত ‘লায়লাতুন মুবারাকাতুন’ বলে থাকে। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান, ভারত ও বাংলাদেশে শবে বরাত অত্যন্ত জমকালোভাবে পালন করা হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো সৌদি আরবে শবে বরাত বলতে কোনো অনুষ্ঠান উদযাপন করা হয় না।

অপর দিকে যারা শবে বরাত পালন করেন না তাদের যুক্তি হল, এ রাত সম্পর্কে যে ধ্যান-ধারনা অনেক মুসলমানের মধ্যে রয়েছে, এর কোনো প্রমাণ কুরআন, সুন্নাহ ও হাদিসে পাওয়া যায় না। তারা বলেন, মহানবীর সা. এর যুগে তো নয়ই, বরং তাবেঈনদের যুগেও এর কোনো নামগন্ধ পাওয়া যায় না। শবে বরাত ইরান থেকে অন্যান্য দেশে ছড়িয়েছে।

শবে বরাত ফার্সি শব্দটিও এদিকে সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে। আসলে লায়লাতুল কদর-এর ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করলে শবে বরাত হয়। ‘শব’ ফারসি শব্দ। এর অর্থ হলো রাত। বরাতও ফার্সি শব্দ; এর অর্থ হলো ভাগ্য। তারা বলেন, এ শব্দটি কুরআন ও হাদিসের কোথাও ব্যবহার হয়নি। তবে এর বিপরীতে সুরা কদরে ‘লায়লাতুল কদর’ শব্দ পাওয়া যায় যা রমজানের সাথে সম্পৃক্ত, শাবান মাসের সাথে নয়।

সুরা দুখানের যে আয়াতটি শবে বরাত সম্পর্কে দলীলরূপে উপস্থাপন করা হয় তা ঠিক নয়। সুরা দুখানের ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন ‘আমি একে নিশ্চয় এই আশীষপূর্ণ রাতে অবতীর্ণ করেছি। এখানে ‘হু’ অর্থাৎ ‘একে’ সর্বনামটি কার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে তা নির্ণয় করতে হবে। সব মুফাসসিরগণ এই সর্বনামটি কুরআনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বলে একমত।

এখন প্রশ্ন হল কুরআন কবে অবতীর্ণ হওয়া শুরু হয়েছে, শাবান মাসে না রমজান মাসে? পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন ‘রমজান সেই মাস যাতে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে।’ (সুরা বাকারা : ১৮৪)। অতএব পবিত্র কুরআন রমজান মাসে অবতীর্ণ হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

উম্মতে মোহাম্মাদিয়া একমত যে, কুরআন রমজান মাসে অবতীর্ণ হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সুরা দুখানে বর্ণিত ‘লায়লাতুন মুবারাকা’ শাবান মাসের নয় বরং রমজান মাসের রাত বলে আল্লাহ তাআলা নির্ণয় করছেন। যাদের মতে ‘লায়লাতুন মুবারাকা’ শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত, তারাও এ কথাটি মানেন যে, কুরআন রমজান মাসে অবতীর্ণ হয়েছে।

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.), হজরত ইবনে ওমর (রা.), মুজাহিদ, কাতাদা ও হাসান বসরির মতো প্রখ্যাত তাফসীরকারকগণ ‘লায়লাতুন মুবারাকা’ বলতে ‘লায়লাতুল কদর’কে আখ্যায়িত করেছেন।

যারা শবে বরাত পালন করেন না তারা আরও বলেন, ‘শবে বরাত’ বা ‘লায়লাতুল মুবারাকা’ যে লায়লাতুল কদর তা কুরআন থেকেই প্রমাণিত হয়। আর এটিও সুস্পষ্ট কদরের রাত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এ ঘোষণা স্বয়ং আল্লাহ্ তাআলার। ১৫ই শাবানের রাতের উল্লেখ পবিত্র কুরআনের কোথাও নেই।

এখন প্রশ্ন উঠে এ রাতে মৃত্যু অথবা ভাগ্য নির্ধারিত হয় অথবা মৃত আত্মীয়স্বজনদের আত্মা পৃথিবীতে আসে এসব কী? এর উত্তর হল কুরআনে ও হাদিসে এর কোনও উল্লেখ নেই। মৃত্যু সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ মরতে পারে না। সেজন্য এক মেয়াদ নির্ধারিত রয়েছে। (সুরা আলে ইমরান : ১৪৫)

আল্লাহ আরও ইরশাদ করেন, ‘তিনি বৃষ্টি অবতীর্ণ করেন। আর গর্ভাশয়ে যা-ই আছে তিনি তা জানেন। আর কেউ জানে না আগামীকাল সে কী উপার্জন করবে এবং এটাও কেউ জানে না কোন স্থানে সে মারা যাবে।’ (সুরা লুকমান : ৩৩)
 
এছাড়া আরও বহু আয়াত রয়েছে যা থেকে জানা যায়, মৃত্যু সম্পর্কিত বিষয়াদি আল্লাহ তাআলা শাবানের ১৫ তারিখ নির্ধারণ করেন না বরং এই তকদীর বা পরিমাপ আল্লাহর হাতে এবং তিনি লায়লাতুল কদরের রাতেও তা নির্ধারণ করেন না। এ মেয়াদ জন্ম হতেই নির্ধারিত হয়।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় আমি সবকিছু এক পরিমাপে সৃষ্টি করেছি। আর আমাদের আদেশ চোখের পলক ফেলার ন্যায় এক নিমিষেই (কার্যকর হয়)।’ (সুরা কামার : ৫০)।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া সেভাবেই অবলম্বন কর যেভাবে তার তাকওয়া অবলম্বন করা উচিত। আর তোমরা কখনো আত্মসমর্পনকারী না হয়ে মৃত্যু বরণ কর না।’ (সুরা আলে ইমরান : ১০২) মৃত্যু যদি ‘লায়লাতুল মুবারাকাতে’ নির্ধারিত হয় তবে এ আয়াতের কী অর্থ করবেন?

ইসলাম এটি বলে না যে, একদিন বা এক রাতে ইবাদত কর, আর প্রয়োজন নেই। আল্লাহ, নামাজ, রোজা, হজ্জ, জাকাত, তাকওয়া, দানখয়রাত এক রাত বা একদিনের ব্যাপার নয়। এ এক নিয়মিত কর্ম। যদি এক রাতেই বছরের সব কিছু নির্ধারিত হয় তবে এক রাতের পর সারা বছর ইবাদত আর আমলের কোনও প্রয়োজন থাকে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি বল, হে আমার বান্দারা যারা নিজেদের প্রাণের ওপর অবিচার করেছ! তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করে দিতে পারেন। নিশ্চয় তিনিই অতি ক্ষমাশীল ও বার বার কৃপাকারী।’ (সুরা আয যুমার : ৫৩)।

এ আয়াত আল্লাহর ক্ষমার দ্বার এক রাতের জন্য নয় বরং প্রতিটি মুহূর্তের জন্য খুলে দিয়েছে। প্রকৃত তওবা করলে যে কোনও দিন, যে কোনও রাত, যে কোনও মুহূর্তে সে আল্লাহর কৃপার অধিকারী হতে পারে। তাই আল্লাহর সিদ্ধান্ত বান্দার আমলের কারণে হয়। ইসলামে কর্ম হলো এক চলমান প্রক্রিয়া যা জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত করে যেতে হবে।

হাদিসের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, মহানবী সা. ‘আইয়্যামুল বীজ’ অর্থাৎ আলোকিত দিনগুলোতে প্রতি মাসে রোজা রাখতেন। আর এ দিনগুলো হল প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ। এ সম্পর্কে বুখারি, নাসাঈ ও মুসনাদ আহমদ বিন হাম্বলে সহিহ রেওয়াত রয়েছে। সুতরাং এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, মহানবী সা. শুধুমাত্র শাবানের ১৫ তারিখে রোজা রাখেননি বরং প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা রেখেছেন।

তবে বিভিন্ন রেওয়াত হতে জানা যায়, শাবান মাসে মহানবী সা. অনেক বেশি রোজা রাখতেন এবং ইবাদত-বন্দেগী করতেন। রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে যে এ রোজাগুলো রাখতেন এতে অধিকাংশ মুহাদ্দেসীন একমত। একজন প্রকৃত মুসলমান হিসেবে আমাদের করণীয় হচ্ছে পবিত্র কুরআনের শিক্ষা ও মহানবীর সা. জীবনাদর্শের ওপর পরিপূর্ণ আমল করে চলা।

পরিশেষে এটাই বলব, মহানবীর সা. জীবনাদর্শ থেকে ১৫ শাবানের রাতে উঠে দোয়া করার বিশেষ কোন শিক্ষা যদি আমরা পেয়ে থাকি তাহলে আমাদেরও উচিত হবে রাতে উঠে গোপনে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে দোয়া করা।

লেখক : কলামিস্ট।


চ্যানেল ৭৮৬ এর নিউজ রুম এ যোগাযোগ করতে ই মেইল করুন এই ঠিকানায় [email protected] । আপনার পন্য বা সেবার প্রচারে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য কল করুন +1 (718) 355-9232 এই নাম্বারে।

সংবাদটি শেয়ার করুনঃ