Channel 786 | চ্যানেল ৭৮৬ | Community Bangla Newspaper

তাকওয়া ও সহমর্মিতার অনুপম শিক্ষা রমজানে

কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক

প্রকাশিত: ০৩:১৫, ৫ এপ্রিল ২০২২

তাকওয়া ও সহমর্মিতার অনুপম শিক্ষা রমজানে

রমজান যেমন বান্দার প্রতি মহান স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালার রহমত বা দয়াকে আকর্ষণ করে, ঠিক তেমনি এক বান্দার প্রতি অপর বান্দার, এক মানুষের প্রতি অপর মানুষের অন্তরে মমত্ব, সহানুভূতি, দয়া ও ভালোবাসার উপলক্ষ সৃষ্টি করে। সিয়াম সাধনার এ মাসটিতে ক্ষুধা ও পিপাসার জ্বালা বাধ্যতামূলকভাবে সয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বিত্তবান-সচ্ছল রোজাদার মানুষ দুঃখী ও অভাবী মানুষের কষ্ট হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হন। 

এভাবেই রোজাদাররা নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে অপরের কষ্ট উপলব্ধি করার ফলে সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও পারস্পরিক ভালোবাসায় সিক্ত হবার স্বতঃস্ফ‚র্ত প্রেরণা বোধ করেন; যে ভালোবাসাকে ঈমানে অঙ্গ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে হাদিস শরিফে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘ঈমানের দৃঢ় বন্ধন হল, আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য দুশমনি করা।’ (বায়হাকি, শুয়াবুল ঈমান : হাদিস নং ১৪)। 

আরেক হাদিসে এসেছে- ‘যে আল্লাহর জন্য দান করে, আল্লাহর জন্য বারণ করে, আল্লাহর জন্য মহব্বত করে, আল্লাহর জন্য দুশমনি করে, আল্লাহর জন্য বিবাহ শাদি দেয়, তার ঈমান পরিপূর্ণ হয়ে যায়।’ (জামে’ তিরমিজি : হাদিস নং ২৫২১)।

হাদিস দ্বারা স্পষ্ট হলো- একজন মুমিনের বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা হবে আল্লাহর জন্য। ঈমানের ভিত্তিতে ভালোবাসাই হল প্রকৃত ভালোবাসা। যে ভালোবাসা ও মহব্বত ঈমানের ভিত্তিতে হয়, সেই ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও মহব্বত কিয়ামতের দিন কাজে আসবে। এ ছাড়া পার্থিব ও জাগতিক স্বার্থে যে সব বন্ধুত্ব বা মহব্বত হয়ে থাকে, তা আখেরাতে কোনো কাজে আসবে না। আল্লাহ তাআলা কোরআনে কারিমে বলেছেন- ‘সেদিন বন্ধুরা একে অন্যের শত্রু হবে, মুত্তাকিরা ছাড়া।’ (সুরা যুখরুফ : আয়াত ৬৭)।

রমজান এসেছে মানুষকে ধৈর্যশীল করার জন্য, মানুষকে শিষ্টাচার শেখাবার জন্য, ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’- এই উপলব্ধিটা যথার্থভাবে বোঝানোর জন্যেই রমজানুল মোবারক এসেছে। একজন মানুষ যখন রোজা রাখে তখন তার জানা থাকে, রোজা অবস্থায় ঝগড়া বিবাদ করা ঠিক নয়।

ঘৃণা ও বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হয়ে মানুষকে দূরে সরানো বা নিজে অন্যের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়াও একইভাবে ঠিক নয়। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করো না, একে অপরের প্রতি হিংসাপরায়ণ হয়ো না, পরস্পরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ো না, পরস্পরের সাথে সম্পর্ক ছেদন করো না। তোমরা আল্লাহ্র বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও। আর কোন মুসলিমের জন্য এটা বৈধ নয় যে, সে তার (মুসলিম) ভাইয়ের সঙ্গে তিনদিনের বেশি কথাবার্তা বলা ত্যাগ করে।’ (সহিহ বোখারি : ৬০৫৬, সহিহ মুসলিম : ২৫৫৯)।

রমজান আমাদের মাঝে এই ভ্রাতৃত্ববোধ অনুশীলনের সুবর্ণ সুযোগটি এনে দেয়। এ মাসে একসাথে ইফতার করা, একে অপরের সাথে বসে কিছু খাওয়া, একসাথে তারাবি নামাজে অংশ নেয়া, ফজরের জামাতে একসাথে নামাজ আদায় করা, জুমার নামাজ একসাথে আদায় করা, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পায়ে পা মিলিয়ে একই কাতারে সামিল হয়ে ঈদের নামাজ পড়া এবং ঘৃণা বিদ্বেষ নিজের মন থেকে চিরতরে বিলুপ্ত করার জন্যে রোজা বড় ধরনের সহায়ক- এতে কোনো সন্দেহ নেই। 

আমরা স্বভাবগতভাবে অন্যকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখি; যা পারস্পরিক ভালোবাসার পথে মারাত্মক অন্তরায়। এই অবজ্ঞার কু-অভ্যাস থেকে মুক্তির উপায় হলো- নিজেকে আল্লাহ্র সমুদয় সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্ট মনে করা। বিনয় অবলম্বন করা। এটা ভেবে নেয়া যে, অমুক লোক সম্ভবত আল্লাহ্র কাছে অধিক নৈকট্যশীল। এদের প্রশংসা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তারা (অপরকে) নিজেদের ওপর প্রাধান্য দেয়।’ (সূরা হাশর, আয়াত ৯)। 

মনে রাখতে হবে, যারা মানুষকে খারাপ জানে, তাদের কর্মের পরিণতি হলো, মানুষ তাদের খারাপ জানবে। এ ধরনের লোকেরা মানুষের সুনামকে ক্ষুণ্ন এবং তাদের যোগ্যতাকে ম্লান করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। সে অন্যদের ওপর তার নিজের বড়ত্ব ও উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার লক্ষ্যে মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন ও ছোট করে। মানুষের সম্মানহানি ঘটানোর উদ্দেশ্যে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে ও অপবাদ রটায়। এটি একটি গর্হিত কাজ।

মুমিন কখনো এমন হতে পারে না। ইসলাম মুমিনদেরকে একটি দেহের সাথে তুলনা করেছে। নু’মান ইবনে বাশির রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘মুমিনদের একে অপরের প্রতি স¤প্রীতি, দয়া ও মায়া-মমতার উদাহরণ (একটি) দেহের মত। যখন দেহের কোন অঙ্গ পীড়িত হয়, তখন তার জন্য সারা দেহ অনিদ্রা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।’ (সহিহ বোখারি : ৬০১১)।

অন্য হাদীসে আছে- ইবনে উমার রা. কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘মুসলিম মুসলিমের ভাই, সে তার ওপর অত্যাচার করবে না এবং তাকে অত্যাচারীর হাতে ছেড়ে দেবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূর্ণ করবে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূর্ণ করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের কোনো এক বিপদ দূর করে দেবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বহু বিপদের একটি বিপদ দূর করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন করবে, আল্লাহ কিয়ামতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন করবেন।’ (সহীহ্ বুখারী : হাদীস নং ২৪৪২, সহীহ্ মুসলিম হাদীস নং ২৫৮০)।

মহান আল্লাহ মানুষের জীবন ও সমাজকে শান্তিপূর্ণ করতে, সাফল্য ও পূর্ণতার সর্বোচ্চ শিখরে উন্নীত করতে, মহামূল্যবান গুন তাকওয়ার শক্তি অর্জন করতে রমজানের মাসব্যাপী রোজা পালন ফরজ করে দিয়েছেন।

একজন রোজাদারের জন্য সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাদ্য-পানীয় ও যৌনতা হারাম। তাই সে রমজান মাসের দিনের বেলায় জীবনের সব থেকে হালাল খাদ্য ও পানীয় যদিও তা মদিনা তাইয়্যিবার সর্বোৎকৃষ্ট আজওয়া খেজুর বা জমজমের পানিই হোক না কেন এবং বিবাহিত স্ত্রীকেও বর্জন করে। কারণ মহান আল্লাহ তাঁর ফরমান দ্বারা এসব হালাল বিষয়কে সাময়িকভাবে হারাম করে দিয়েছেন। 

আল্লাহ নির্দেশ অমান্য করলে জাহান্নামে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। এভাবে এক মাস রোজার অনুশীলনের মাধ্যমে রোজাদার সত্যিকার মুমিন ভাবতে বাধ্য হয়, যে বিষয়গুলোকে মহান আল্লাহ সারাটি জীবনের জন্য হালাল করেছেন, যে বিষয়গুলোকে আল্লাহর রাসূল সাওয়াবের কারণ বলেছেন, সাময়িক নিষেধাজ্ঞার কারণে ওই বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করলে যদি জাহান্নামের এত কঠিন শাস্তি অবধারিত হতে পারে, তাহলে যে বিষয়গুলো গোটা জীবনের জন্য হারাম, জীবনের কোনো ক্ষেত্রে কোনো সময়ে যা হালাল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, সে বিষয়ে যদি আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করা হয়, তা হলে তার শাস্তিটা কত ভয়াবহ হতে পারে! অর্থাৎ এক মাস রোজা পালনের মাধ্যমে প্রত্যেক রোজাদার তাঁর গোটা জীবনে হালাল অর্জন ও হারাম বর্জনের নৈতিক শিক্ষা অর্জন করবে তথা তাকওয়া অর্জন করবে- এটাই রোজার আসল শিক্ষা।

সংবাদটি শেয়ার করুনঃ