আমি দাঁড়িয়ে আছি পবিত্র মক্কা নগরী থেকে ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বে হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর স্মৃতি বিজরিত শহর এবং ঐতিহাসিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি তায়েফ নগরীর মসজিদে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের সামনে। তিনি ছিলেন উম্মতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং একজন বিখ্যাত পণ্ডিত, জ্ঞান বিজ্ঞান ও ফিকাহ শাস্ত্রে তিনি অগাধ পাণ্ডিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তাঁর নিকট থেকে খলিফা উমর ও উসমান (রাঃ) পরামর্শ নিতেন। তাঁর সম্পর্কে উমর (রাঃ) বলতেন هو فتى الكهول (তিনি বয়সে নবীন আর জ্ঞানে প্রবীণ)। তিনি ছিলেন রঈসুল মুফাসসিরীন। তাঁর লিখিত তফসীরগ্রন্থ ‘তাফসীরে ইবনে আব্বাস’ জগদ্বিখ্যাত।
জিবরাঈলের দর্শন: তিনি স্বচক্ষে হযরত জিবরাঈল (আঃ) দুই বার দেখেছেন।
রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন: হযরত আলী (রাঃ) এর শাসনামলে তিনি বসরার গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন। ৩৭ ও ৩৮ হিজরীতে সংঘটিত যথাক্রমে জঙ্গে জামাল ও জঙ্গে সিফফিনে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সিফফীনের যুদ্ধ বন্ধের চুক্তিতে তিনি স্বাক্ষর করেছিলেন।
হাদীস বর্ণনা: সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী ৬ জন সাহাবীর অন্যতম হলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)। তিনি ১৬৬০ টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। বুখারী ও মুসলিম যৌথভাবে ৯৫ টি, এককভাবে বুখারীতে ১২০ টি এবং মুসলিমে ৪৯ টি হাদীস উল্লেখ রয়েছে। তাঁর নাম আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাঃ)। আবদুল্লাহ নাম, আবুল আব্বাস কুনিয়াত। পিতা আব্বাস, মাতা উম্মুল ফাদল লুবাবা। কুরাইশ বংশের হাশেমী শাখার সন্তান। রাসূলুল্লাহর সা. চাচাতো ভাই এবং উম্মুল মুমিনীন হযরত মায়মুনা রা. তাঁর আপন খালা।
মহান সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. নানা দিক থেকেই সম্মান ও গৌরবের অধিকারী ছিলেন। রক্ত-সম্পর্কের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা.) চাচাতো ভাই। অগাধ জ্ঞান পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি আরব জাতি তথা উম্মাতে মুহাম্মাদীর ‘হাবর ও বাহর’ (পূণ্যবান জ্ঞানী ও সমুদ্র) উপাধি লাভ করেছিলেন। তাকওয়া ও পরহিযগারীর তিনি ছিলেন বাস্তব নমুনা। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি দিনে রোযাদার, রাতে ইবাদাত গোযার এবং রাতের শেষে প্রহরে তাওবাহ ও ইসতিগফারকারী। আল্লাহর ভয়ে তিনি এত বেশী কাঁদতেন যে, অশ্রুধারা তাঁর গণ্ডদ্বয়ে দু’টি রেখার সৃষ্টি করেছিল।
তাঁর মা প্রখ্যাত সাহাবিয়্যা উম্মুল ফাদল লুবাবা বিনতুল হারিস আল-হিলালিয়্যা আবদুল্লাহ ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাঁকে কোলে করে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট নিয়ে যায়। রাসূল সা. নিজের পবিত্র মুখ থেকে একটু থু থু নিয়ে শিশু আবদুল্লাহর মুখে দিয়ে তাঁর তাহনীক করেন। এভাবে তার পেটে পার্থিব কোন বস্তু প্রবেশের পূর্বেই রাসূলে পাকের পবিত্র ও কল্যাণময় থু থু প্রবিষ্ট হয়। আর সেইসাথে প্রবেশ করে তাকওয়া ও হিকমাত।
সাত বছর থেকেই তিনি রাসূলুল্লাহর (সা.) সেবা ও খিদমতে আত্মনিয়োগ করেন। অজুর প্রয়োজন হলে তিনি পানির ব্যবস্থা করতেন, নামাজে দাঁড়ালে তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে ইকদেতা করতেন এবং সফরে রওয়ানা হলে তিনি তাঁর বাহনের পেছনে আরোহন করে তাঁর সফরসঙ্গী হতেন। এভাবে ছায়ার ন্যায় তিনি তাঁকে অনুসরণ করতেন এবং নিজের মধ্যে সর্বদা বহন করে নিয়ে বেড়াতেন একটি সজাগ অন্তঃকরণ, পরিচ্ছন্ন মস্তিষ্ক এবং আধুনিক যুগের যাবতীয় রেকর্ডিং যন্ত্রপাতি থেকে অধিক শক্তিশালী একটি স্মৃতিশক্তি।
উম্মুল মু’মিনীন হযরত মায়মূনা রা. হযরত আবদুল্লাহর খালা হওয়ার কারনে অধিকাংশ সময়ে তাঁর কাছে কাটাতেন। অনেক সময় রাতে তাঁর ঘরেই শুয়ে পড়তেন। এ কারণে খুব নিকট খেলে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে রাসূলুল্লাহর (সা.) সাহচর্য লাভে তিনি ধন্য হয়েছেন। রাতে রাসূলুল্লাহর (সা.) সাথে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় ও তাঁর অজুর পানি এগিয়ে দেওয়ার সুযোগও লাভ করেছেন। একবার হযরত মায়মূনার ঘরে তাহাজ্জুদ নামাযে রাসূলুল্লাহর সা. বাম দিকে দাঁড়িয়ে গেলে তিনি আবদুল্লাহর মাথা ধরে ডান দিকে দাঁড় করিয়ে দেন।
আমর ইবন হাবশী বলেন, ‘আমি ইবন উমারকে একটি আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেনঃ তুমি ইবন আব্বাসের কাছে যাও এবং তাকেও জিজ্ঞেস কর। কারণ মুহাম্মাদের সা. ওপর যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে সে সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের যাঁরা অবশিষ্ট আছেন তাঁদের মধ্যে তিনিই অধিক জ্ঞানী।’’৬৮ হিজরী মুতাবিক ৬৮৬/৮৮ খ্রীস্টাব্দে তায়েফ নগরে তিনি ইনতিকাল করেন। ওফাতের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল একাত্তর বছর। মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়্যা তাঁর জানাযার ইমামতি করেন। তায়েফ নগরে ‘মসজিদে ইবন আব্বাস’ নামক বিশাল মসজিদটি আজও তাঁর স্মৃতি বহন করে চলেছে। এ মসজিদেরই পেছনের দিকে এক পাশে এ মহান সাহাবীর কবর রয়েছে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) কবরে সমাহিত করার পর কুরআনের এ আয়াতটি পঠিত হয়েছিল:يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ – ارْجِعِي إِلَىٰ رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً – فَادْخُلِي فِي عِبَادِي – وَادْخُلِي جَنَّتِي ‘হে পরিতুষ্ট আত্মা! তুমি প্রসন্ন ও সন্তুষ্ট অবস্থায় তোমার প্রতিপালকের দিকে প্রত্যাবর্তন করো। অতঃপর আমার বান্দাগণের মধ্যে প্রবিষ্ট হও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।’ (আল-ফজরঃ ২৭-৩০)
—তায়েফ,সৌদি আরব (তথ্য সংগৃহীত )।