Channel 786 | চ্যানেল ৭৮৬ | Community Bangla Newspaper

৯০% টিকা দিয়ে ধনী দেশগুলোকে লজ্জা দিল কিউবা

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৮:৩৩, ৭ জানুয়ারি ২০২২

৯০% টিকা দিয়ে ধনী দেশগুলোকে লজ্জা দিল কিউবা

কোভিডের বিরুদ্ধে টিকাগুলোর বেশির ভাগই আগেভাগে কিনে গুদামজাত করে ফেলেছে ধনী রাষ্ট্রগুলো। তাদের কারণে ঝুঁকির মুখে পড়েছে দরিদ্ররা। অথচ তারাই এখনো আশানুরূপ টিকা দান নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের লাগামহীন সংক্রমণ ধনী দেশগুলোকে নতুন করে বিধিনিষেধের পথে হাঁটতে বাধ্য করছে। 

আর ওদিকে যে দ্বীপ দেশটি আলো জ্বালাতেই হিমশিম খায় তারা এরই মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি জনগণকে টিকা দিয়ে ফেলেছে। 

উনিশ শতকে স্পেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম নায়ক জেনারেল ম্যাক্সিমো গোমেজ একসময় বলেছিলেন, ‘কিউবানরা হয় লক্ষ্য ছোঁয় না- নয়তো লক্ষ্যকে অতিক্রম করে চলে যায়!’ 

দেড় শতাব্দী পরে তাঁর সেই বাণীই সত্য হলো! দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনীতির দ্বীপটির হয়তো আলো জ্বালানোর সামর্থ্য নেই, কিন্তু তারাই এখন বিশ্বের যেকোনো বড় দেশের তুলনায় কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবচেয়ে বেশি সফলতা দেখিয়েছে। 

সরকারি তথ্য এবং পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের বেশি কিউবান অন্তত একটি ডোজ টিকা পেয়েছেন। আর ৮৩ শতাংশ জনগণ পেয়েছে পূর্ণ ডোজ। দেশে উদ্ভাবিত কোভিড টিকাই দিয়েছে কিউবা। ১০ লাখের বেশি জনসংখ্যার দেশগুলির মধ্যে একমাত্র সংযুক্ত আরব আমিরাতেরই ব্যাপকভিত্তিক টিকা নিশ্চিত করার রেকর্ড রয়েছে। 

কানাডার ডালহৌসি ইউনিভার্সিটির ল্যাটিন আমেরিকান স্টাডিজের ইমেরিটাস অধ্যাপক জন কার্ক বলেন, ‘কিউবা এক জাদু বাস্তবতার দেশ! মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যা এবং সীমিত আয় নিয়ে কিউবা একটি প্রাণপ্রযুক্তিতে শক্তিধর দেশ হতে পারে, এমন ধারণা ফাইজারে কর্মরত কারও পক্ষে বোধগম্য হবে না। কিন্তু কিউবার পক্ষেই এটি সম্ভব!’ 

বেশিরভাগ লাতিন আমেরিকার দেশের মতো, কিউবাও জানত যে টিকা কিনতে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়তে হবে। তাই ২০২০ সালের মার্চে, পর্যটন রাজস্ব হ্রাস এবং যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নতুন নিষেধাজ্ঞার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার বিপর্যয় সঙ্গী করে দ্বীপ রাষ্ট্রটির বিজ্ঞানীরা কোমর বেঁধে নেমেছিলেন। 

বলতে গেলে তাঁরা জুয়া খেলতে নেমেছিলেন: জিতেও গেছেন। ২০২১-এর বসন্তের মধ্যে কিউবা বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ হিসেবে সফলভাবে নিজস্ব কোভিড টিকা উদ্ভাবন ও উৎপাদন শুরু করে। এরপর থেকেই দক্ষ ও আন্তরিক স্বাস্থ্যকর্মী, সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবার বিপর্যয়ের ঝুঁকি কাঁধে নিয়ে দ্রুত টিকা দান কর্মসূচি শুরু করে। এমনকি শিশুদেরও টিকা দিয়েছে কিউবা। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, এখানে জনগণ স্বেচ্ছায় টিকা নিয়েছে। যেখানে পশ্চিমা দেশগুলোতে টিকা বিরোধিতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত বসন্তে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফল অনুসারে, কিউবার দুটি কোভিড টিকাই ৯০ শতাংশের বেশি কার্যকর। সফল টিকাদান কর্মসূচিই দেশটিতে সংক্রমণের হার ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে। যেখানে গত গ্রীষ্মে পশ্চিম গোলার্ধের দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ সংক্রমণের দেশগুলোর মধ্যে ছিল কিউবা। 

গত আগস্টে কিউবা প্রতি সপ্তাহেই কোভিডে শত শত মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। যেখানে গত সপ্তাহে মৃত্যু ছিল তিনজন। 

সর্বজনীন টিকা দানে কিউবার এই সাফল্য আলাদা করে উল্লেখ করার মতো ঘটনা, যখন অবরোধে জেরবার দেশটিতে স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য খাতের অবস্থা অত্যন্ত ভঙ্গুর। গত দুই বছরে অভ্যন্তরীণ মুদ্রা প্রবাহ অর্ধেকে নেমে গেছে, দেশটিতে অ্যান্টিবায়োটিক এখন এতটাই দুষ্প্রাপ্য যে অ্যামোক্সিসিলিনের ২০টি ট্যাবলেট কালোবাজার থেকে কিনতে এক মাসের ন্যূনতম সরকারি বেতনের সমান টাকা খরচ করতে হচ্ছে। 

ভাঙা হাড়ের চিকিৎসায় প্লাস্টার করতে কিছু প্রদেশের ডাক্তারেরা এখন ব্যবহৃত কার্ডবোর্ডের ওপর নির্ভর করছেন! 

হাভানা-ভিত্তিক আইনজীবী গ্রেগরি বিনিওস্কি ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘১৯৫৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে, কিউবানরা এই মহান ক্রুসেডগুলো শুরু করেছে। খুবই অবাস্তব, তবুও প্রায়ই সফল হই।’ 

উদাহরণ হিসেবে বিনিওস্কি বলেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর প্রাণপ্রযুক্তিতে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের এক স্বপ্ন ফিদেল কাস্ত্রোর পরিকল্পনার পাইপলাইনে ছিল। ওই সময় যেকোনো যুক্তিবাদী পরামর্শকই বলতেন, যে প্রকল্পের ফল পেতে ২৫ বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে সেখানে সম্পদ বিনিয়োগ করার সময় এটি নয়। তবুও আমরা কিন্তু এখন এখানে… যেখানে প্রাণপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগের ফলই এখন জীবন বাঁচাচ্ছে।’ 

অবশ্য কাস্ত্রোর সব পরিকল্পনাই কাজ করেছে এমন নয়। বেশ কিছু উদ্যোগই নাটকীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন, ১৯৭০ সালে ১ কোটি টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যে আখ চাষ উৎসাহিত করার উদ্যোগের কথা বলা যায়। শ্রমিকদের নিয়মিত কাজ থেকে এনে আখ কাটতে লাগিয়ে দেওয়া হয়। এই পদক্ষেপ শিল্পকে পঙ্গু করে দেয়। ফলত অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ায়। 

গত বছর কিউবা ১৯৫৯ সালের তুলনায় সাত গুণ কম চিনি সংগ্রহ করেছে। 

কানাডার রয়্যাল মিলিটারি কলেজের ইতিহাস ও কৌশলের ইমেরিটাস অধ্যাপক হ্যাল ক্লেপাক বলেন, ‘একটি জাতি হিসেবে বড় জিনিসগুলোতে বেশি ভালো করার প্রবণতা থাকে। আর সাধারণ বিষয়গুলোর ব্যাপারে উদাসীনতার কারণে ভয়ংকর ফল হয়। যেমন, এক দশকের কম সময়ের মধ্যে পুরো দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা, আড়াই বছরে নিরক্ষরতা দূর করা এবং চিকিৎসা আন্তর্জাতিকীকরণ- এগুলো সবই ছিল পাগলামি। কিন্তু তারা (কিউবা) এটা করেছে।’ 

আজ কিউবা হাজার হাজার চিকিৎসক এবং নার্স তৈরি করছে। তাঁরা বিদেশে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে মানবিক কাজ করছেন। কিন্তু দেশের জনগণের জন্য পর্যাপ্ত আলু উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছে কিউবা। এটা সত্যিই একটা ট্র্যাজেডি! 

এর জন্য দায়ী করা যেতে পারে কিউবার অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত এবং রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ব্যবস্থাকেই। বিশ্বে এ ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থার সর্বশেষ দৃষ্টান্তগুলো একটি হয়ে আছে কিউবা। উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের প্যারাডক্স (কূটাভাস) ব্যাখ্যা করার কিছু উপাদান হয়তো তারা রেখে যাচ্ছে। শীর্ষ পর্যায়ে যখন রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে তখন ইতিবাচক লক্ষ্যগুলোকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। যখন সঠিক দিকনির্দেশের অভাব হয়, তখন দ্বীপ দেশটির কঠোর অনমনীয় সরকার ব্যবস্থার হাল ধরতে সামনে এসে হাজির হয় কাফকায়েস্ক আমলাতন্ত্র। যাদের প্রকৃত কোনো লক্ষ্য উদ্দেশ্য, দায় কিছুই না থাকার মতো এক ভয়ংকর কদর্য রূপ অনেক দেশে মাঝে মধ্যে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। 

এদিকে গত সপ্তাহজুড়ে প্রতিদিন একজন কোভিড রোগী শনাক্ত হচ্ছে কিউবায়। অত্যন্ত সংক্রামক ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের কারণেই সংক্রমণের হার এখন বাড়ছে। কিউবার বিজ্ঞানীরা ওমিক্রনের বিরুদ্ধে তাঁদের টিকার কার্যকারিতা সম্পর্কে এখনো তথ্য প্রকাশ করেননি। টিকাটি হালনাগাদ করার চেষ্টা করছেন তাঁরা। 

এরই মধ্যে, কিউবার জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু করেছে। চলতি জানুয়ারি মাসেই প্রায় শতভাগ বুস্টার ডোজ দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে কিউবা।

সংবাদটি শেয়ার করুনঃ