Channel 786 | চ্যানেল ৭৮৬ | Community Bangla Newspaper

ঈদুল আযহা: পরিবেশ দূষণ, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও ইসলামি দিকনির্দেশনা

সাঈদ মাহমুদ সোহরাব

প্রকাশিত: ২২:১০, ১৪ জুলাই ২০২১

ঈদুল আযহা: পরিবেশ দূষণ, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও ইসলামি দিকনির্দেশনা

মহামারী আতংকে পুরো বিশ্ব থেমে গেছে। অর্থনীতির চাকা আর আগের মতো ঘুরছে না, ফুয়েল ফুরিয়ে যেন শেষ সময়ের প্রহর গুনছে। পুঁজিবাদী সমাজে আধিপত্য বিস্তার করতে পরিকল্পনা ছাড়াই গড়ে উঠেছে কল-কারখানা। বিষাক্ত ধোঁয়াতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, পরিবর্তিত হচ্ছে জলবায়ু।

স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও দূষিত বায়ুতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি, নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছি, কিন্তু আমাদের হুশ নেই। সেই হুশ ফিরিয়ে দিতেই যেন প্রাকৃতিক ট্রিটমেন্ট হয়ে এলো করোনা। এখন আমাদের চলাফেরা, আচার-আচরণে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

এদিকে, জিলহজ্ব মাস হজ্জ্বে আকবর ও ইদুল আযহার আগামবার্তা নিয়ে ফিরছে। তবে মুসলিম বিশ্বের নিকট এই সময়টি অন্যান্য বছরের চেয়ে ভিন্ন। ভিন্ন রকম এক অনুভূতির সময় হয়ে স্মরণীয় থাকবে সকলের কাছে। সর্বোচ্চ সতর্কতা নিশ্চিত করতে প্রথমবারের মতো হজ্জ্বে আকবরে বিশাল জমায়েতকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। মক্কার নিকটবর্তী লোকবলকে নিয়েই পালিত হবে এবারের হজ্জ। কিন্তু কেন? কেননা, নিরাপদ থাকা এবং নিরাপদে রাখা দুটোই ইসলামের নির্দেশনা।

কুরবানিতে পরিবেশ দূষণের সম্ভাবনা থাকে সবচেয়ে বেশি। দেশজুড়ে একই সময়ে প্রাণী কুরবানি দেয়া হয়। কিন্তু কুরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকলে সে বর্জ্য পঁচে-গলে পরিবেশ দূষিত করে। দূষণ থেকে হতে পারে নানান ধরণের রোগ।

২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে বিশ্ব ব্যাংক জানায়, দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২৮ শতাংশ মানুষ মারা যায় কেবল পরিবেশ দূষণজনিত অসুখবিসুখের কারণে। অথচ সারা বিশ্বে এধরনের মৃত্যুর গড় মাত্র ১৬ শতাংশ।

পরিবেশ দূষণ মৃত্যু ছাড়াও দেহে বিভিন্ন ধরণের রোগের সৃষ্টি করে। তা হলো-

১. দূষিত পরিবেশে বেড়ে উঠা শিশুদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ব্যাহত হয় এবং স্নায়ুবিক ক্ষতি হয়ে থাকে।
২. দূষিত এলাকায় বসবাসের ফলে গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যেতে পারে।
৩. মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান লরেন্স বের্কলি ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি বলছে, রাসায়নিক মিশ্রণ আছে, এমন দুষিত বায়ুর সংস্পর্শে থাকলে চোখ, নাক বা গলার সংক্রমণ বা ক্ষতির কারণ হতে পারে। সেই সঙ্গে ফুসফুসের নানা জটিলতা, যেমন ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া, মাথাব্যথা, অ্যাজমা এবং নানাবিধ অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৪. বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন বায়ু দূষণের মধ্যে থাকলে বা এরকম পরিবেশে কাজ করলে ফুসফুসের ক্যান্সার এবং হৃদরোগের দেখা দিতে পারে। এমনকি সেটা মস্তিষ্ক, লিভার বা কিডনির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও তৈরি করতে পারে।
৫. যুক্তরাজ্যের ওয়াটার পলুউশন গাইড, যারা পানির মাধ্যমে দূষণের মাত্রা কমাতে কাজ করছে, তারা বলছে, পানি দূষণে সাময়িক প্রভাবের তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব অনেক বেশি পড়ে।
৬. বিজ্ঞানীরা বলছেন, দুষিত পানি বা নদীর ভেতর যেমন মাছ বা প্রাণী থাকে, যেসব ভেজষ উৎপন্ন হয়, দূষণ সেসব প্রাণীর ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ে। খাদ্যচক্রের মাধ্যমে এসব ক্ষতিকর পদার্থ আবার মানব দেহের শরীরে চলে আসে। যার ফলে ক্রুটি পূর্ণ জন্ম বা ক্যান্সার হতে পারে।

পরিবেশ দূষণরোধে ইসলাম কী বলে-
পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা ইসলামি সৌন্দর্যের অন্যতম। সুস্থ, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ আমাদের বুদ্ধির বিকাশে সহায়তা করে। মহান আল্লাহ বলছেন- তোমরা স্মরণ কর, যখন তোমাদেরকে আদ জাতির পরে প্রতিনিধি করেছেন; তোমাদেরকে পৃথিবীতে ঠিকানা দিয়েছেন। তোমরা নরম মাটিতে অট্টালিকা নির্মাণ কর এবং পর্বত গাত্র খনন করে প্রকোষ্ঠ নির্মাণ কর। অতএব আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করো না।’ (সূরা আরাফ : ৭৪)। তিনি আরো বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ সীমা অতিক্রমকারীদেরকে পছন্দ করেন না। (সূরা মায়িদাহ-৮৭)

রোগ-অসুখ, ঝড়-তুফান প্রভৃতি বিষয়ের জন্য যে আমরা দায়ী সে ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুণ সমুদ্র ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে।’ (সূরা আর রুম : ৪১)। অন্য আয়াতে তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘তোমরা নিজেদের ধ্বংস নিজেরা ডেকে এনো না।’ (সূরা বাকারা : ১৯৫)। এছাড়াও, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে আল্লাহ তা'আলা বলেন, ‘আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকে তাদেরও।’ (সূরা বাকারা: ২২২)

পরিবেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত রাখার জন্য আসমান থেকে আল্লাহ বর্ষণ করেন স্বচ্ছ পবিত্র পানি। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ আকাশ থেকে যে পানি বর্ষণ করেন, তা দ্বারা পৃথিবীকে মৃত্যুর পর সজীব করেন। প্রত্যেক প্রকারের জীবজন্তুর বিস্তৃতি ঘটান। আসমান ও জমিনের মাঝখানে নিয়ন্ত্রিত বায়ু ও মেঘ পানির পরিবর্তনে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন বিদ্যমান।’ (সূরা বাকারা: ১৬৪) এবং তার অনুসারীদের উৎসাহিত করেছেন।

পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব বুঝানোর জন্য হাদিসে অসংখ্যবার তাগিদ দেয়া হয়েছে- 
১. সাইদ ইবনে মুসাইয়িব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্রতা পছন্দ করেন। আল্লাহ পরিচ্ছন্ন, তিনি পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করেন। অতএব তোমরা তোমাদের উঠোনগুলো পরিচ্ছন্ন রাখবে। (তিরমিজি: ২৭৯৯)। 
২. আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, তোমাদের কেউ যেন বদ্ধ পানিতে প্রস্রাব না করে অতঃপর তা দিয়ে গোসল করে। (বুখারি: ২৩৯, মুসলিম: ২৮২)। 
৩. আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদিসে বলা হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, কষ্টদায়ক জিনিস রাস্তা থেকে সরানো হচ্ছে সাদকাহ। (বুখারী: ২৯৮৯, মুসলিম: ১০০৯)। 
৪. রাসুল (সা.) বলেছেন, ঈমানের সর্বনিম্ন শাখা হচ্ছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেয়া। (মুসলিম: ৩৫)। 
তবে, কেবল প্রাতিষ্ঠানিক পরিকল্পনাই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে যথেষ্ট নয়, যদি না নাগরিক পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি না পায়। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর অধিক সতর্ক হতে হবে। পরিবেশ দূষণ রোধে, স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে ও সংকটকালীন মুহূর্তে পরিবার ও সমাজকে নিরাপদ রাখতে অন্য বছরের তুলনায় এ বছর আমাদের সর্বোচ্চ সচেতনতায় এগিয়ে আসতে হবে।

ব্যক্তিগতভাবে পরিবেশ দূষণরোধে এগিয়ে আসতে আমরা পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের যেসব পরামর্শ গ্রহণ করতে পারি-
১. কোরবানির পর বর্জ্য নিজের বাড়ির সামনে রেখে মশা-মাছির চারণক্ষেত্রে পরিণত না করে বরং নিজেদের উদ্যোগে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা করা।
২. এককভাবে কোরবানি না করে, মহল্লাভিত্তিক একটি নির্ধারিত স্থানে কোরবানি করা যেতে পারে। যাতে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে বর্জ্য অপসারণ সহজ হয়।
৩. কোরবানির পর একই ভবনের বেশ কয়েকটি পরিবার মিলে একটি সোসাইটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
৪. জবাই কৃত পশুর গোবর ও উচ্ছিষ্ট আলাদা করে খোলা ভাবে না ফেলে সেগুলো ব্যাগে ভরে নির্ধারিত স্থান যেমন নিকটস্থ ডাস্টবিন বা কন্টেইনারে ফেলতে হবে।
৫. পশু জবাইয়ের স্থানে কোরবানির পর পশুর রক্ত জীবাণুনাশক পানি দিয়ে ধুয়ে দিয়ে ব্লিচিং ছিটিয়ে দিতে হবে। যাতে করে দুর্গন্ধ না ছড়ায় বা জমে থাকা পানি দূষিত না হয়।
৬. তাছাড়া, গ্রামীণ জনগোষ্ঠী নির্দিষ্ট স্থানে গর্ত খুঁড়ে বর্জ্য মাটিচাপা দিতে পারে। পরবর্তী সময়ে তা জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করার সুবিধা পাবে।

সর্বোপরি, করোনাকালীন এমন সংকটমুহূর্তে পরিকল্পিতভাবে বর্জ্য অপসারণ করতে মহল্লা কমিটি ও সামাজিক সংগঠনগুলো যদি এগিয়ে আসে তবে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে বলে আশা করি। যা পরবর্তী সময়ের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুনঃ