করোনা মহামারিতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চরম মন্দার সময়েও প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার প্রকাশ এক সপ্তাহের জন্যও বন্ধ থাকেনি। ছাপা ও অনলাইন সংস্করণ উভয় মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে। মৃত্যু যখন বিভীষিকার অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছিল নিউইয়র্কের আলোকোজ্জ্বল নাগরিক রূপ, তখনো সর্বশেষ আপডেট নিয়ে খবরের শিরোনাম বড় হরফে লিখে নগরবাসীর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে সংবাদপত্র—‘প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা’। ‘ভালোর সঙ্গে আলোর পথে’ প্রথম আলোর এই স্লোগানের আলোকেই পথ চলে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা।
এ কারণেই প্রথম আলো নিউইয়র্কে খবরের বাতিঘর হয়ে দিন রাত জ্বলেছে। আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছে নিউজ ব্যাংক স্থাপন করে। মহামারির বিভীষিকা নেমে আসা দেশটার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নগরের নাগরিক জীবনের প্রাণস্পন্দনে যখন কাঁপন, তখনো এই মৃত্যুপুরীতে প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে নগরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ছুটে বেরিয়েছে আবাসিক সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার টিম।
ইব্রাহীম চৌধুরী চৌকস সাংবাদিক। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশ গঠন সংকল্পে নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংগঠনিক তৎপরতায়। স্বপ্ন দেখতেন শোষণহীন, শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থার বাংলাদেশ। যৌবনে একসময় পারিবারিক ভিসায় চলে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে। আবাস গড়ে তুলেছেন নিউজার্সি স্টেটের জার্সি সিটি নগরীর উপকণ্ঠে। সাংগঠনিক দক্ষতাকে শান দিয়ে নিজের চারদিকে তৈরি করে নিয়েছেন বিশাল একদল লেখক বাহিনী। লেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। সাহস যুগিয়ে এসেছেন নিয়মিত।
২০১৯ সালের মার্চে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে তাঁর সাহসেই নিয়মিত সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই নব্য রিপোর্টারের দল ঝুঁকি নিয়ে খবর সংগ্রহে, মানবতার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেই সব রিপোর্ট, সাহসিকতা, মানুষের প্রতি দরদ, ভালোবাসার গল্প কথা, মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ফিরিয়ে দেওয়ার গল্প তাঁরা লিখেছেন ‘প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা’র পাতায় পাতায়। সেই সব ভীত সন্ত্রস্ত দিনের কথা, আতঙ্কে শ্বাস বন্ধ হওয়ার রাত জাগা দিনগুলোর কথা, সহকর্মী, সহযোদ্ধাদের লড়াইয়ের কথা, বেঁচে পরিবারে ফিরে আসার আনন্দ, বন্ধু, স্বজন হারানো বুক ফাটা ক্রন্দনের কথাগুলি গ্রন্থাকারে জীবন্ত করে তুলেছেন ইব্রাহীম চৌধুরী তাঁর প্রকাশিত দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘করোনা: ডেটলাইন নিউইয়র্ক’ বইয়ে। তাঁর রচিত প্রথম গ্রন্থ ‘স্মৃতিতে ও সংবাদে’। রিপোর্টিংয়ের আদলে লেখা হলেও তা সুখপাঠ্য এবং লেখক ইব্রাহীম চৌধুরীর সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছিল। পাঠক মনে আশা জাগিয়ে তুলেছিল। দ্বিতীয় এই গ্রন্থটি বিশ্বব্যাপী করোনার উৎপত্তি, সংক্রমণ বিস্তৃতি, দুর্মূল্য মানব জীবনের অকালপ্রয়াণ, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া আতঙ্ক, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, অপরদিকে এর দমন, দমন সংক্রান্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের চিন্তা ও মতামত সংক্রান্ত তথ্য, উপাত্ত, তত্ত্ব নির্ভর দালিলিক কোনো গ্রন্থ হয়তো নয়। তবে এতে এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের করোনার সংক্রমণজনিত ছড়িয়ে পড়া আতঙ্ক, বিশ্বের অর্থনৈতিক রাজধানী খ্যাত নগর নিউইয়র্কের মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হওয়ার করুণ পরিস্থিতিতে এই জনপদের প্রতিদিনের জনজীবনের ছবি গেঁথে তোলা হয়েছে।
ইব্রাহীম চৌধুরী পেশায় ও নেশায় একজন সাংবাদিক। খুব কাছে থেকে অবিশ্বাস্য দক্ষতায় এবং দ্রুততায় তাঁর রিপোর্ট লেখার ক্ষমতা দেখে মাঝে মাঝে বিস্ময় জেগেছে মনে। তবে রিপোর্ট লেখার হাতে মাঝে মাঝে টাইপের অক্ষরগুলোকে সাহিত্যের ঘরে সাজাতে দেখেছি। তাঁকে অনেকবারই সাহিত্যের লেখা লিখতে উৎসাহী করতে চেয়েছি। তবে বুঝেছি শেষতক সাংবাদিকতাই তাঁর স্থায়ী ঘর বসতি। যত দূর জানি, তিনি গদ্য সাহিত্য লেখায়ও মনোনিবেশ করছেন। আশা করি লেগে থাকলে সে ক্ষেত্রেও তিনি সোনা ফলাতে সক্ষম হবেন। কবিতার প্রতি তাঁর ভালোবাসা আগ্রাসী। এত কবিতা পড়ে ভেতরে ভরে রেখেছেন, অবাক মানি, যেকোনো লেখার বা বলার প্রয়োজনে তিনি রেফারেন্স হিসেবে শুধু বাংলা ভাষার বিখ্যাত কবিদের কবিতা নয়, বিশ্ব সাহিত্যের পাঠ থেকে তুলে নিতে পারেন অনায়াসে।
তাঁর এই কবিতা প্রেম আমাদের একটি মস্ত উপকার করেছে—তাঁর উৎসাহে ‘প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা’র আয়োজনে নিউইয়র্ক থেকে নিয়মিতভাবে প্রতি মাসে বাংলা কবিতার প্রতিনিধিত্বশীল প্ল্যাটফর্মে উৎকৃষ্ট ‘কবিতার এক পাতা’ প্রকাশিত হয়ে আসছে আজ তিন বছর। ‘কবিতার এক পাতা’ প্রকাশের অপেক্ষায় থাকেন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বাংলা কবিতার অগ্রসর পাঠক। এটি বাংলা কবিতার দেশ ও বিদেশের মেলবন্ধন তৈরি করে দিয়েছে। ইব্রাহীম চৌধুরীর এই সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে আমার কুণ্ঠা নেই।
সম্প্রতি ইব্রাহীম চৌধুরী তাঁর ‘করোনা: ডেটলাইন নিউইয়র্ক’ গ্রন্থ নিয়ে শুরু করেছেন ‘বুক ট্যুর’। নিউইয়র্কের কয়েকটি বরোতে তিনি ভিন্ন ভিন্ন সমাবেশে গ্রন্থ নিয়ে উপস্থিত থেকেছেন সুধী পাঠক ও আয়োজক সমাবেশে। সমাবেশে বইটির বিষয় তুলে ধরেছেন তিনি। আলোচনা করেছেন আলোচকেরা। আগ্রহ নিয়ে বইটি হাতে তুলে নিয়েছেন আগ্রহী ও মননশীল পাঠক। এই বুক ট্যুর বিষয়টি বেশ আলোড়ন তুলেছে। আলোচিত হচ্ছে মুখে মুখে। এর সীমানা ক্রমশ নিউইয়র্ক ছাড়িয়ে ওয়াশিংটন, মেরিল্যান্ড, ভার্জিনিয়ার শুভানুধ্যায়ীর আয়োজন অতিক্রম করে গত সপ্তাহে ট্যুর করে এসেছে মিশিগান অঙ্গরাজ্যে।
মিশিগানে অনেক বাঙালির বাস। বুক ট্যুর আয়োজন মিশিগানের হ্যামট্রামাক শহরে বাংলাদেশি ভাইবোনদের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছিল। করোনার দীর্ঘ অবরুদ্ধ সময় পেরিয়ে তাঁরা যেন মুক্তির শ্বাস নিতে একত্র হয়েছিলেন অনুষ্ঠানে। নগরীর মেয়র আন্তরিকতা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন সেখানে এবং নিজ আগ্রহে বেশ কয়েকটি বই ক্রয় করেন বিশিষ্টজনদের দেবেন বলে।
স্থানীয় বইপ্রেমী ও লাইব্রেরিতে দেওয়ার জন্য স্থানীয় বিশিষ্টজন দেবাশীষ মৃধা একাই অর্ধশত বই কিনে নিয়েছেন। তাঁরা জানতে চান, জানাতে চান করোনার সময়কে।
ইব্রাহীম চৌধুরী অবশ্য এই সাফল্যকে দেখছেন মানুষের পারস্পরিক ভালোবাসার দৃষ্টিতে। তিনি বিশ্বাস করেন, এভাবেই পারস্পরিক মেলামেশা, একে অপরকে জানা চেনার মধ্যে দিয়েই সব সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।
চ্যানেল ৭৮৬ এর নিউজ রুম এ যোগাযোগ করতে ই মেইল করুন এই ঠিকানায় [email protected] । আপনার পন্য বা সেবার প্রচারে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য কল করুন +1 (718) 355-9232 এই নাম্বারে।