‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক আলোচনা সভা
মহেন্দ্রক্ষণ অতিক্রম করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। হাঁটি হাঁটি পা পা করে বিশ্ববিদ্যালয়টি পা দিয়েছে ১০০ বছরে। এ উপলক্ষ্যে চ্যানেল ৭৮৬ এর উদ্যোগে ‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় গতকাল ৬ জুলাই নিউইয়র্ক সময় রাত ১০টা এবং বাংলাদেশ সময় ৭ জুলাই সকাল ৮টায়।
নুপুর চৌধুরীর উপস্থাপনায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. হাবিবা খাতুন, সঙ্গীতশিল্পী তামি জাকারিয়া, অ্যাটর্নি রাজু মহাজন, ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির এডজাঙ্কট প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমান, বাফেলোর হেলথ ইনফরমেশন এডমিনিস্ট্রেটর হাসান আমজাদ খান। তারা প্রত্যেকেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতিচারণ করেছেন।
নুপুর চৌধুরী
উপস্থাপক
আজকে আমাদের জন্য একটি বিশেষ দিন। কারণ এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা একত্র হতে পেরেছি। আমরা স্মৃতিচারণ করবো, আড্ডা দেব, গান শুনবো। চেষ্টা করবো এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিছু সময়ের জন্য হলেও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটাকে ফিরিয়ে আনার। চ্যানেল ৭৮৬ কে ধন্যবাদ, এমন একটি আয়োজন করা জন্য। বিশেষ ধন্যবাদ এই চ্যানেলের প্রধান মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ভাইকে, যিনি রয়েছেন এই অনুষ্ঠান আয়োজনের পেছনে।
আমাদের সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল আরও উত্তাল
প্রফেসর হাবিবা খাতুন
অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
সাবেক প্রভোস্ট, শামসুন্নাহার হল
আমি সত্তরের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম। সেই সময় এখনকার মতো এত নারী শিক্ষার্থী ছিল না। আমাদেরকে ক্লাসে গেলে রীতিমতো সমাদর করা হতো। আমাদের সময়ে কিন্তু ইংরেজিতে পড়ানো হতো। শিক্ষকতা জীবনের শুরুতেও আমরা ইংরেজিতে পড়িয়েছি। তারপর তো ধীরে ধীরে সেটা বাংলায় রুপান্তরিত হয়েছে। আমি মনে করি, মাতৃভাষায় পাঠদানের বিষয়টি অনেক ইতিবাচক একটা পরিবর্তন।
এখনও ক্যাম্পাসে রাজনীতি আছে তবে তখনকার পরিস্থিতি ছিল আরও খারাপ। এনএসএফের তখন খুব প্রতাপ ছিল। মারামারি, হাঙ্গামা লেগেই থাকতো। আমাদের ছাত্রীদের ব্যাপারে ক্লাসের ছাত্ররা খুব কেয়ারিং ছিল। আমরা যেন কোনোভাবে হাঙ্গামার মধ্যে আটকা না পড়ি, সেজন্য তারা সবসময় সচেষ্ট থাকতো। এককথায় তারা আমাদেরকে খুব আগলে রেখেছে।
১৯৭৩ সালে আমি ঢাকা বিশ^বিদ্যলয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের খুব প্রতাপ ছিল। তাদের অনেকেই এমন ছিল যে, কাউকেই তোয়াক্কা করতো না। আমদের বিভাগ থেকেও এমন কয়েকটি ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গেছে। সেখান থেকে ফিরে এসে তারা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। শিক্ষকদেরকে মানতো না। মেয়েদেরকে উত্যাক্ত করতো। একবার দুজন ছাত্রীকে আমি বখাটেদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার জীবনে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে
হাসান আমজাদ খান
হেলথ ইনফরমেশন এডমিনিস্ট্রেটর, বাফেলো
আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন ৮৮ সালের বন্য। দেশের অনেক অঞ্চল তলিয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ক্লাস বন্ধ ছিল। তাতে আমরা ছেলেমেয়েরা মিলে রুটিসহ আর নানা খাবার তৈরির কাজে লেগে গেলাম। তারপর এসব খাবার পৌঁছে দিতাম পানিবন্দি মানুষের কাছে।
আরেকটি ঘটনার কথা আমার খুব মনে পড়ছে। তখনকার রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল খুব বেশি। আমাদের পরীক্ষা থাকতো সপ্তাহের শনিবারে। একদিন পরীক্ষা দিতে এসে দেখি, পরীক্ষার হলের দরজায় তালা মারা। পরে বিষয়টা জানতে পারলাম, যারা স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে, তারাই এটা করেছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো পরীক্ষা হতে দেবে না। কিন্তু তাদের ভয়ে বিষয়টা কেউ মুখ ফুটে বলতো। এভাবে চতুর্থ সপ্তাহেও যখন পরীক্ষা হচ্ছে না। তখন ভিসি স্যার আসলেন। আমি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা হলে থাকো অথচ বলতে পারছ না, কারা এটা করছে? আমি বললাম, স্যার, এটা বোধহয় বায়বীয় কোনো ব্যাপার। স্যার আমার দিকে তাকালেন এবং বললেন, কবিতা লেখা হয় নাকি? সেই কথাটা এখনো আমার মনে আছে।
আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যারা আমার মধ্যে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম। আমি তাকে জীবনভর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবো। যাকে সারা পৃথিবীতে মৃত্তিকা বিজ্ঞানের জগতে মি. ফসফরাস বলে ডাকা হয়। ৫ বছর ধরে তিনি আমাদের ক্লাস নিয়েছেন। এর মধ্যে তিনি ক্লাসে আসতে পারেননি, এমন ঘটনা ঘটেছে মাত্র দুদিন। বিষয়টি আমাকে আলোকিত করেছে।
ক্লাসের পড়ার চেয়ে এক্সট্রা কারিকুলারে ছিলাম বেশি
মোস্তাফিজুর রহমান খান
পিএইচডি গবেষক ও এডজাঙ্কট প্রফেসর, ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি
আমি ৯৮-৯৯ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। আমার বিষয় ছিল সমাজ কল্যাণ। ভর্তি হয়ে জানতে পারলাম, এই সাবজেক্টে নাকি একজন মাত্র ফার্স্ট ক্লাস পায়। বুঝতে পারলাম, সেটা নিশ্চয়ই আমি নই। তাই একাডেমিক পড়াশোনা বাদ দিয়ে বিতর্কের দিকে মনোযোগী হলাম। মুহসীন হল ডিবেটিং ক্লাবের সভাপতি ছিলাম। ডিপার্টমেন্টে বিতর্ক ক্লাব খুললাম। বিভিন্ন হলে গিয়ে বিতর্ক করেছি। ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলাম। শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন জেলায় আমরা বিতর্ককে নিয়ে গেছি।
শুধু বিতর্ক নয়, অন্যান্য এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটির সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম। ক্যাম্পাসেই আমি মার্শাল আর্ট শিখেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুডো ও কারাতে আমরাই শুরু করি। একটা ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে আমিই প্রথমবারের মতো সেটার আহ্বায়ক হই। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অসংখ্য স্মৃতি আছে আমাদের ঝুলিতে।
পড়াশোনার চাপের মধ্যেও সাংস্কৃতির প্রোগ্রামে সরব ছিলাম
তামি জাকারিয়া
সঙ্গীতশিল্পী ও ভাইস প্রেসিডেন্ট, চেইজ ব্যাংক
২০০৪-এ ভর্তি হই বিবিএ প্রোগ্রামে। পড়াশোনার খুব চাপ ছিল আমাদের। কিন্তু তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সাংস্কৃতির প্রোগ্রামে সরব উপস্থিতি ছিল। হলের বিভিন্ন কম্পিটিশনের যোগ দিতাম। আড্ডা দিতাম। গান গাইতাম। বিএনসিসি করতাম। কিছুই আসলে বাদ ছিল না। আরেকটি বিষয় বলে রাখি, আমার বাবা-মা, বোনরাসহ আমার পরিবারের ৫ সদস্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। তাই ক্যাম্পাসটা যেন আমার কাছে আরেকটা পরিবারের মতো। এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমার আবেগের শেষ নেই।
বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরপুর আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন
রাজু মহাজন
অ্যাটর্নি রাজু মহাজন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস
আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস হলো ঝগড়ার ইতিহাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটিং সোসাইটিতে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি। কিন্তু শেষের দিকে এসে ঝগড়া করে বেরিয়ে গেলাম। তারপর ফিল্ম সোসাইটি তৈরি করলাম। সেখানে ১ বছর কাজ করার পর সেখান থেকেও ঝগড়া করে বেরিয়ে গেছি। সরাসরি ছাত্র ইউনিয়ন না করলেও আমার অনেক বন্ধু ছিল এই ছাত্র সংগঠনটিতে। মধুর ক্যান্টিনে তাদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম। তারপর তাদের সঙ্গেও একসময় ঝগড়া বেধে যায় এবং তাদের সাথে আড্ডা দেওয়া বন্ধ করলাম। এজন্যই বলছি, ঝগড়ার ইতিহাস!
আমি জহুরুল হক হলে থাকতাম। তখন ছাত্রদল ক্ষমতায়। তাদের দুই গ্রুপের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা। ঘটনাচক্রে আমি মাঝখানে পড়ে গেলাম। আমাকে হল থেকে বের করে দেয়া হলো। তখন কী করবো, ভেবে অস্থির। খালার বাসা ছিল ঢাকায়, কিন্তু সেখানে গেলাম না, কারণ বাবা-মা টেনশন করবে। সারাদিন ক্যাম্পাসে আড্ডা মারতাম আর রাত হলে পাবলিক লাইব্রেরিতে বই মাথার নিচে দিয়ে ঘুমিয়ে থাকতাম। তিনদিন পর পরিস্থিতি শান্ত হলে তারপর হলে উঠেছি। এমন নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরপুর আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন।
আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, সেটা হলো- বাংলাদেশের কনটেক্সটে আমি একটু বেশিই কালো। হয়তো কেউ ভাবতে পারতো না, বাংলাদেশের মানুষ এমন কালো হতে পারে। তাছাড়া আমার চুলও ছিল একটু কোকড়া ধরনের। সবমিলিয়ে আমাকে আফ্রিকান মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। স্বাভাবিকভাবে তাই ঘটলো। অকেকেই আমাকে আফ্রিকান মনে করতো এবং সেভাবেই ডাকতো। আমার অবশ্য তাতে কিছু মনে হতো না। বিষয়টাকে সাধারণভাবে নিতে পেরেছিলাম।