গ্লোবাল মুনসাইটিং ও লোকাল মুনসাইটিং—বিষয়টি নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত মুসলিম বিশ্ব। এক পক্ষের বক্তব্য হলো, পৃথিবীর যে প্রান্তেই চাঁদ দেখা যাক না কেন, তাতে ঈদ পালন করবে সারা বিশ্বের মুসলমান। আরেক পক্ষ বলছে লোকাল মুনসাইটিংয়ের কথা। অর্থাৎ, নিজ দেশে কিংবা অঞ্চলে চাঁদ দেখা গেলে তবেই ঈদ পালন করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষকরে নিউইয়র্কে চাঁদ দেখা যায় না বললেই চলে। তাছাড়া মুসলিমপ্রধান না হওয়ায় এখানে চাঁদ দেখা নিয়ে কোনো তোড়জোড় নেই। নেই কোনো চাঁদ দেখা কমিটি। তাই এখানকার মুসলমানদের জন্য চাঁদ দেখে রোজা রাখা, রোজা ভাঙা এবং ঈদ করাটা খুব মুশকিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই আলোচনায় উঠে আসে গ্লোবাল মুনসাইটিংয়ের কথা।
শুধু নিউইয়র্কেই দুই পক্ষ দুদিন ঈদ পালন করেছে—ঘটেছে এমন ঘটনাও। উম্মাহর ঐক্যের জন্য এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটিকে বাঁধা বলছেন অনেকেই। আলোচনায় উঠে এসেছে এবারের ঈদুল আজহাও। ঈদ ১৬ নাকি ১৭ জুন—এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জোরেশোরেই। এ নিয়ে নিউইয়র্কের শীর্ষ আলেমদের সঙ্গে কথা বলেছে চ্যানেল৭৮৬।
‘অদূর ভবিষ্যতে একইদিনে ঈদ করবে সারাবিশ্বের মুসলমান’
আবু জাফর বেগ
ইমাম, জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার
এটা আসলে অনেকটা বিশ্বাসের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা দেশ বা অঞ্চলের শাসকগোষ্ঠী জানালো যে, চাঁদ দেখা গেছে। প্রশ্নটা হলো, অন্যরা সেটা বিশ্বাস করলো কিনা। বিশ্বাস করলে তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ঈদ করাতে কোনো সমস্যা নেই।
ধরা যাক, সৌদি আরব বলেছে যে, চাঁদ দেখা গেছে। আমরা তো নিশ্চয়ই সৌদি আরবকে অবিশ্বাস করি না, সেক্ষেত্রে সৌদিতে চাঁদ দেখা গেলে আমরা ঈদ করতেই পারি। ইমাম আবু হানিফার (র.) মত কিন্তু এমনটাই। অন্যদিকে, লোকাল মুনসাইটিংয়ের কথা বলেছেন ইমাম শাফী (র.)। তবে বলা বাহুল্য যে, ইমাম শাফীর সময়কার পৃথিবী আর এখনকার পৃথিবী মোটেও এক নয়। তখন এক দেশ থেকে আরেক দেশে একটা তথ্য পাঠাতে কয়েকদিন লাগতো, আর এখন এক সেকেন্ডও লাগে না।
আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে, যারা লোকাল মুনসাইটিংয়ের পক্ষে। এর মধ্য দিয়ে তারা কোনো অপরাধ করছে, এমনটাও আমি বলছি না। তবে সবার উচিত বিষয়টা নিয়ে ভাবা, চিন্তা করা। আশার কথা হলো, অনেকেই ভাবছেন এবং গ্লোবাল মুনসাইটিংয়ের কথা বলছেন। আমি মনে করি, অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বের সব মুসলমান একইদিনে ঈদ করবে, ইনশাআল্লাহ।
‘মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করা উচিত নয়’
মুফতি আবদুল মালিক
ইমাম, আমেরিকান মুসলিম সেন্টার
ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হলো, মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ। তবে বলা বাহুল্য, কিছু বিষয়ে এখনও আমাদের মধ্যে মতবিরোধ আছে, যার একটি হলো গ্লোবাল মুনসাইটিং-লোকাল মুনসাইটিং। সারাবিশ্বের মুসলমানরা একইদিনে ঈদ করতে পারলে সেটা হবে দারুণ ব্যাপার। মনে রাখা দরকার, আমরা যারা গ্লোবাল মুনসাইটিংয়ের কথা বলছি, তারা কিন্তু একই সময়ে রোজা ভাঙা বা ঈদের নামাজ আদায় করার কথা বলছি না। সময়ের ব্যবধানের কারণে সেটা সম্ভবও নয়। মূল কথাটা হলো, পৃথিবীর কোনো একটা প্রান্তে চাঁদ দেখা গেছে, এটা জানার পর থেকে ঈদের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে আলাদা দিনে ঈদ করতে হবে না।
সাধারণত ওয়েস্টার্ণ ওয়ার্ল্ড আগে চাঁদ দেখে, ইস্টার্ণ ওয়ার্ল্ড দেখে পরে। তবে সেই সময়ের ব্যবধান ২৪ ঘণ্টার বেশি হয় না। তাছাড়া লোকাল মুনসাইটিংয়ে ‘লোকাল’ বলতে কতটুকু সীমানা বোঝানো হচ্ছে, সেটাও আরেকটা বড় প্রশ্ন। কেউ বলছেন, লোকাল বলতে দেশের সীমানা বুঝানো হয়েছে। আবার অনেকে বলছেন, লোকাল বলতে শুধু নিজ এলাকার সীমানাকেই বুঝানো হবে। প্রাচীণকালে চাঁদ দেখা যাওয়ার পর ঘোড়া যতটুকু যেতে পারতো, ওই সীমানার মধ্যে সবাই ঈদ পালন করতেন। তবে এখন তো টেলিফোনই যথেষ্ট। চাঁদ দেখা গেলে সেকেন্ডর মধ্যেই জানিয়ে দেওয়া সম্ভব লাখ লাখ মাইল দূরের কাউকে।
‘সারাবিশ্বে একইদিনে ঈদ উদযাপন সম্ভব নয়’
ইমাম জাকারিয়া
বায়তুশ শরফ মসজিদ, নিউইয়র্ক
ঈদ বা ঈদের নামাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। তবে এটা ইন্ডিভিজুয়াল নয়, সামষ্টিক ইবাদত। তাই সারাবিশ্বে এটা একইদিনে পালন করা যায় কি-না, সেটা নিয়ে প্রতিবছরই একটা আলোচনা উঠে আসছে। আমরা যারা নিউইয়র্কে থাকি, তারা কিন্তু চাঁদ দেখিনা বললেই চলে। দেখিনা বলতে, দেখতে পাই না আসলে। আমি ২০০১ সালে বাংলাদেশ থেকে এসেছি, এই ২৩ বছরে ঈদের চাঁদ দেখেছি একবার কিংবা দুবার। আমাদেরকে তাকিয়ে থাকতে হয় ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে। তাছাড়া বাংলাদেশের মতো এখানে চাঁদ দেখার জন্য কোনো সরকারি কমিটি নেই, যারা চাঁদ দেখার ঘোষণা দেবে। তাই পার্শ্ববর্তী দেশ বা অঞ্চলে চাঁদ দেখার খবর পাওয়া গেলে ঈদ করা যাবে। এতে কোনো সমস্যা নেই।
তবে আমার মতে, সারাবিশ্বে একইদিনে ঈদ সম্ভব নয়। সময়ের ব্যবধানের কারণেই এটা অসম্ভব। তাছাড়া একইদিনে ঈদ করতে গেলে আরও অনেক ইবাদত নিয়ে জটিলতা দেখা দিতে পারে। দুই অঞ্চলের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ২৪ ঘণ্টার কম হলেও দিনের শুরু এবং শেষের হিসাব করলে ২৪ ঘণ্টা পরে ঈদ পালন করতে হবে—এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।