ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ এক সময়ে অন্যায়, অত্যাচার, অবিচারের মূলোৎপাটন করতে ধুমকেতুর মতোই জগতে আগমন ঘটেছিল কবি কাজী নজরুল ইসলামের। তাকে বলা হয় মানবতার কবি, সাম্যের কবি। এই জাতীয় কবির ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার ব্যাপারে বলতে চ্যানেল৭৮৬-এর মুখোমুখি হয়েছিলেন আরেক কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।
কবি নজরুলের জীবনকে এক কথায় কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
তিনি সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মাননি। স্বাভাবিকভাবেই নানা ঝড়-ঝাপটার ভেতর দিয়ে গেছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সবকিছু ঠিক থাকলে হয়তো নিজেকে আরও বিকশিত করতে পারতেন। তারপরও দারিদ্রতা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, তুমি মোরে করেছো মহান। আসলেই, নজরুলের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ জীবনই তাকে মহান করে তুলেছে।
জাতীয় কবির জীবনের কোন সময়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?
২১, ২২, ২৩ এই বয়সগুলোতে বিস্ফোরণের মতো আগমন ঘটে নজরুলের। তার পরের আরও কিছু বছর তিনি সাহিত্যাকাশে তিনি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। কবিতা লেখার জন্য জেলে গিয়েছেন। এই সময়ই তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা বিদ্রোহী লিখেছেন। এই সময়ই ধুমকেতু পত্রিকা বের করেছেন। রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছিলেন। জেলে তিনি যখন অনশন করছেন, তখন রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখে বলেছেন, তোমাকে আমাদের দরকার।
এত সংকটের মধ্যে কবি লিখতেন কীভাবে?
তিনি আমাদের মতো সাধারণ মানুষ ছিলেন না। যাকে বলে সত্যিকার অর্থেই গড গিফ্টেড, তিনি ছিলেন তাই। শুধু সংকট নয়, তার বয়স যখন ৪২, তখন নির্বাক হয়ে যান। লেখালেখি বন্ধ হয়ে যায়। সবমিলিয়ে তার ক্রিয়েটিভ কাজের সময়টা ছিল খুবই অল্প। কিন্তু এই অল্প সময়েই তিনি অসাধারণ সব কাজ করেছেন।
তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হল কখন?
কবি নজরুল জন্মগ্রহণ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায়। ১৯৭২ সালে তাকে বাংলাদেশে এনে জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল। এই দেশে আসার পর তিনি মাত্র ৪ বছর বেঁচেছিলেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি পিজি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭৪ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি’লিট উপাধি দেয়। সেই একই বছর তাকে একুশে পদক দেওয়া হয়। আমাদের বাংলা একাডেমি কিন্তু ওই চার বছরের মধ্যে তাকে পুরস্কার দিতে পারতো, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটা ঘটেনি।
নজরুলকে স্মরণে আমরা কি কার্পণ্য করছি?
কবি নজরুলের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে কেসরকারিভাবে অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন আয়োজনের উদ্যোগ নেয়। এবার তার ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তেমনটা দেখা গেছে। কিন্তু তিনি তো জাতীয় কবি, তাকে সম্মান জানানো উচিত জাতীয়ভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে। কিন্তু সেটা হয় না, যা অত্যন্ত খুবই দুঃজনক। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন আজকের বাংলাদেশের সীমানার বাইরে, কিন্তু তার মৃত্যু তো বাংলাদেশের সীমানার ভেতর। তাই জন্মবার্ষিকী না হোক, অন্তত তার মৃত্যুদিনটি বিশেষ মর্যাদায় রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা উচিত। সরকারপ্রধান এবং রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে তার কবরে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো যেতে পারে।
নজরুলের জীবনের কোন ঘটনাটি আপনাকে নাড়া দেয়?
এই মুহূর্তে তার জীবনের একটা গল্প মনে পড়ছে। তাকে যখন কবিতা লেখার কারণে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়, তখন এক ইংরেজ কর্মকর্তা জেলে নজরুলকে দেখতে এলেন। কারণ তিনি নজরুলের কথা অনেক শুনেছেন। ওই কর্মকর্তার সঙ্গে নজরুলের দেখা হলো, কিছুক্ষণ আলাপ হলো। নজরুল বিদায় নিতে উদ্যত হলেন। পরক্ষণেই ঘুরে দাঁড়িয়ে ওই কর্মকর্তাকে বললেন, বায়রনের নাম শুনেছ? ওই কর্মকর্তা কিছুটা বিরক্তির সঙ্গেই বললেন, ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত কবি বায়রনকে না চেনার কী আছে? তারপর নজরুল বললেন, বায়রনের সময় ইংরেজদের শাসক কে ছিলেন? এবার ওই কর্মকর্তা আমতা আমতা শুরু করলেন, কারণ উত্তরটা তিনি জানেন না। তখন নজরুল বললেন, শাসককে কেউ মনে রাখে না, কবিকেই সবাই মনে রাখে। এটা ছিল ওই শাসকের গালে চপেটাঘাত।
নজরুল কতটা অসাম্প্রদায়িক ছিলেন?
শতভাগ। শুধু লেখায় নয়, নজরুল কত বড় অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন, সেটা তার জীবনেও ফুটে উঠেছে। তিনি প্রমীলা দেবী নামে একজন হিন্দু নারীকে বিয়ে করেছিলেন। প্রমীলাকে তিনি কিন্তু মুসলমান বানানোর চেষ্টা করেননি। একই ঘরের মধ্যে নজরুল নামাজ পড়েছেন আর প্রমীলা পূঁজো করতেন। ছেলের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মোহাম্মদ! এভাবে নজরুলের পুরো জীবনাচারের মধ্যেই ছিল কঠোর ধর্মনিরপেক্ষতা।
নজরুল চর্চা কতটা হয় আসলে?
আমি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে দেখেছি, যেখানে বাঙালি আছেন, সেখানে কমবেশি নজরুল চর্চা হয়। তবে যতটা হওয়ার কথা, ততটা আসলে হয় না। তবে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মেইন স্ট্রিমে যদি ব্যাপকভাবে নজরুল চর্চা না হয় তাহলে নিউইয়র্কের বাঙালিরাও নজরুল চর্চা করবে না-এটাই স্বাভাবিক। যদি ঢাকাতে নজরুল চর্চা হয়, তাহলে নিউইয়র্কে হবে, লন্ডনে হবে, টরন্টোতে হবে। নজরুল চর্চায় এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকেও। একটা তেতো সত্য হলো, রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে আমরা যেমন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেখি, নজরুলের ক্ষেত্রে তেমনটা দেখি না। এখন তো অনেকে নজরুলকে জাতীয় কবি থেকেই মুছে ফেলার চেষ্টা করছেন!
সংগীতজ্ঞ হিসেবে নজরুলকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
কবি নজরুল একজন সঙ্গীতজ্ঞও বটে। তিনি ১৮টি রাগ সৃষ্টি করেছেন, যা বড় বড় সংগীতজ্ঞরাও সৃষ্টি করতে পারেননি। তিনি অসংখ্য গান লিখেছেন, সুর করেছেন, গেয়েছেন। যেমন তার একটা গান… ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন, খুঁজি আমি তারে আপনায়।’ কী অসাধারণ এই গানের কথা। কী মর্ম কথা!
কবি নজরুল তার লেখায় প্রচুর বিদেশি শব্দ ব্যবহার করেছেন। এটা কেন?
সত্য যে, নিজের লেখায় প্রচুর বিদেশি শব্দ ব্যবহার করেছেন কবি নজরুল। সম্ভবত আর কোনো লেখক তার মতো এত বিদেশি শব্দ ব্যবহার করেননি। এত ব্যবহার করেছেন, তারপরও শব্দগুলো আরোপিত মনে হয়, মনে হয় না যে তিনি জোর করে শব্দগুলো বসিয়েছেন। এটাই আসলে গড গিফ্টেড প্রতিভা।
ইংরেজি ভাষায় নজরুল কতটা অনূদিত হয়েছেন?
যথেষ্ট বলা যায় না। কিছু কিছু অনুবাদ হয়েছে। নজরুলের সঞ্চয়িতার অনুবাদ করেছেন অধ্যাপক মুস্তাফা মুনীর বলে এক আমেরিকান এক ভদ্রলোক। এছাড়া বিদেশের মাটিতে নজরুলকে নিয়ে প্রচুর কাজ করছেন ড. গুলশান আরা। তার স্বামী কাজী বেলালও চেষ্টা করছেন। তারা দুজন মিলে কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল চেয়ার করার চেষ্টা করছেন। বিষয়টা অনেক দূর এগিয়ে গেছে বলে শুনেছি।
পাঠ্যপুস্তকে নজরুল কি কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন?
সম্ভবত। এটা খুবই দুঃখজনক এবং অন্যায়। নজরুল আমাদের জাতীয় কবি, সেই কবির একটি কবিতা যদি শিশুরা স্কুলে গিয়ে পড়তে না পারে, সেটা তো ঠিক হলো না। নজরুল সকল ধরনের কবিতা লিখেছেন। ক্লাস ওয়ানে পড়ানোর মতো কবিতা যেমন আছে, আবার পিএইচডি করার মতো কবিতাও নজরুল লিখে গেছেন।
নজরুলের জীবন এবং লেখালেখি থেকে কী শিখবার আছে আমাদের?
প্রথমত অসাম্প্রদায়িকতা, দ্বিতীয়ত মানবতা। আরেকটা কথা, আমরা যারা লেখালেখি করি তাদের জন্য কবি নজরুল একটি দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, একজন লেখক হবে স্বাধীন। তিনি কারও কাছে মাথানত করবেন না। একজন লেখক কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করবেন না। প্রকৃত কবির একটিমাত্র লাইন থেকে একটি রাজনৈতিক দল তৈরি হতে পারে। কবিকে কোনো রাজনীতি ধারণ করতে পারে না বরং একজন কবি ধারণ করেন সকল রাজনীতি।
চ্যানেল ৭৮৬ এর নিউজ রুম এ যোগাযোগ করতে ই মেইল করুন এই ঠিকানায় [email protected] । আপনার পন্য বা সেবার প্রচারে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য কল করুন +1 (718) 355-9232 এই নাম্বারে।