Channel 786 | চ্যানেল ৭৮৬ | Community Bangla Newspaper

মসজিদ-মাদরাসা প্রাঙ্গণে আলহাজ জোবেদা বেগমের কবর

সাইদ রহমান

প্রকাশিত: ২১:৪০, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

আপডেট: ২১:৩৭, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

মসজিদ-মাদরাসা প্রাঙ্গণে আলহাজ জোবেদা বেগমের কবর

মাদরাসা প্রাঙ্গনে মরহুমার কবর

আলহাজ জোবেদা বেগম। প্রচারের আড়ালে থাকা একজন মহিয়সী নারী, আদর্শ মা, একজন রত্নগর্ভা। ভাষাসৈনিক আলহাজ মো. ওসমান আলীর সহধর্মিণী। কবি লিলি হকের মতো বরেণ্য মানুষের জন্মদাত্রী। তার অন্য সন্তানরা সবাই দেশ-বিদেশে সুপরিচিত এবং সুশিক্ষিত। এই মহিয়সী নারীর আজ তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। সেই উপলক্ষে চ্যানেল-৭৮৬ এর মুখোমুখি হয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেছেন কবি লিলি হক। মায়ের জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি নানা বৃত্তান্তের পাশাপাশি জানিয়েছেন মাকে নিয়ে তার স্বপ্নের কথা। জানিয়েছেন- জোবেদা বেগমের বেড়ে ওঠা, ধর্মচর্চা, সততা, অসাম্প্রদায়িকতাসহ নানা কিছু-

শুরুতেই জোবেদা বেগমের জন্ম ও বেড়ে ওঠা সম্পর্কে জানতে চাই।
১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসে নেত্রকোণা জেলার সুষম দূর্গা গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আমার মা জোবেদা বেগম। তার বাবা, মানে আমার নানা জাহেদ আলী ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। সেই সুবাদে ছোট বেলাতেই বাংলাদেশের কয়েকটি জেলা ঘুরে বেড়িয়েছেন। আমার বাবার সঙ্গে মায়ের বিবাহ হয় ১৯৫১ সালে। যখন বিয়ে হয় তখন মায়ের বয়স বড়জোর ১০-১১ বছরের মতো হবে। 

আপনার মায়ের পরিবার ব্যবস্থাপনা কেমন ছিল?
একজন নারী, যিনি ১২টি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন এবং গভীর মমতা আর অভিনিবেশে সেই পরিবারটিকে গড়ে তুলেছেন তিল তিল করে। প্রত্যেকটি সন্তানের দিকে আলাদা আলাদাভাবে মনোযোগ দিয়েছেন। কার, কোথায় কী সমস্যা কিংবা কিসে আগ্রহ- মা সেসব জানতেন অত্যন্ত ভালোভাবে। আর সেভাবেই জীবনের শেষ দিনগুলোতেও পরিবারের ব্যবস্থাপনা করে গেছেন। আমাদেরকে আগলে রেখেছেন। আমার সন্তানরা যখন অনেক বড় হয়ে গেছি, আলাদা হয়েছে তখনও মা আমাদেরকে বিবেচনা করেছেন সেই ছোট্ট শিশুটির মতো।

তার ধর্মচর্চার ব্যাপারে কিছু বলুন।
মা কতটা ধর্মপরায়ণ ছিলেন, সেটা বলে বোঝানো কিছুটা মুশকিল হবে। এতগুলো সন্তানের দায়িত্ব পালনের পরও মাকে কখনো নামাজ কাজা করতে দেখিনি। আমাদেরকে খাবার দিয়ে হয়তো উঠে গেছেন, নামাজে দাঁড়িয়েছেন। আবার রাতে আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়ছি, তখনও দেখতাম মা নামাজ পড়ছেন। সারাদিনই কোনো না কোনো দোয়া-দুরুদ আওড়াতে থাকতেন। আমরা যখন বাইরে যেতাম, দোয়া পড়ে আমাদের মাথায় ফু দিয়ে দিতেন। মা এসব ধর্মচর্চা পেয়েছেন বাবার কাছ থেকে। আমার বাবা ধর্মের বিধানের ব্যাপারে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত একচুলও ছাড় দেননি।

সন্তানদের কী পরামর্শ দিতেন জোবেদা ওসমান?
মোটাদাগে দুটি ব্যাপার বলতে পারি। এক. মা আমাদেরকে সব বিষয়ে এবং সর্বক্ষণ সৎ থাকার পরামর্শ দিতেন। আমি মনে করি, এটাই মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমার বাবাও ছিলেন অসম্ভব সৎ মানুষ। তার সততার গল্প কিংবদন্তিতুল্য। মা-ও ছিলেন তেমই। 
দুই. মা ছিলেন খুব ধর্মপরায়ণ। তার কাছ থেকে ধর্মের প্রতিটি বিষয় শিখেছি। এই ষাটোর্ধ্বে জীবনে এখনো তার সেই শিক্ষা বহমান। জীবনে যা-ই করি না কেন, মায়ের শিক্ষা ছিল, ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলো যেন মেনে চলি। সেটা চেষ্টা করে যাচ্ছি অবিরাম। শিল্পকলা একাডেমিতে হয়তো প্রোগ্রাম থাকে, অনেক বড় বড় শিল্পী-সাহিত্যিকরা থাকেন- এর মধ্যেও নামাজের সময় হলে এক কোণায় গিয়ে নামাজটা আদায় করে আসি। মায়ের কাছ থেকেই এই শিক্ষা পেয়েছি। 

আলহাজ জোবেদা বেগম দানশীল হিসেবে কেমন ছিলেন? 
আমার বাবা আলহাজ ওসমান আলী ছিলেন খুবই সৎ মানুষ। রেজিস্ট্রি অফিসে চাকরি করলেও তাকে কোনোদিন নির্ধারিত বেতনের বাইরে একটি পয়সা কোথাও থেকে নিয়েছেন বলে শুনিনি। তারওপর আমরা ভাইবোন বেশি হওয়াতে খরচও ছিল বেশি। তাতে করে আমাদের পরিবারে একপ্রকার টানাপোড়েন লেগেই থাকতো। কিন্তু তারপরও মা সাধ্য অনুযায়ী মানুষকে দান করতেন। নিজে ছেড়া কাপড় পড়েছেন, অথচ অন্যকে দানও করে গেছেন। মা যেন ঠিক নিজের জন্য কখনোই বেঁচে ছিলেন না। পুরো জীবনটাকে তিনি অন্যদের জন্য উৎসর্গ করেছেন।

প্রতিবেশীর সাথে কেমন সম্পর্ক ছিল তার?
এককথায় দারুণ। তিনি তো কখনোই কারো সঙ্গে খারাপ আচরণ করতেন না। আমরা সন্তানরা কখনোই তেমনটা দেখিনি। প্রতিবেশির সঙ্গে অত্যন্ত সুন্দর আচরণ করতেন। তাদেরকে যথাসাধ্য সাহায্য করতেন। বিপদে পড়লে পাশে দাঁড়াতেন। তাতে করে প্রতিবেশিরা তাকে খুব পছন্দ করতো। দেখতাম, কোনো সংকটে পড়লেই তারা মায়ের কাছে ছুটে আসতো। মা-ও কাউকে নিরাশ করতেন না। হয়তো ঘরে পরবর্তী দিনের জন্য যেটুকু খাবার রাখা আছে সেখান থেকে কিছুটা দিয়ে দিতেন অভাবী প্রতিবেশীকে। 

আপনার লেখক সত্তার বিকাশে আপনার মা কতটুকু প্রভাব ফেলেছেন?
আমার লেখকজীবনের অনেকখানিজুড়েই আছেন মা। তিনি হয়তো সরাসরি আমার লেখক হয়ে ওঠার পেছনে ছিলেন না, কিন্তু প্রভাবক ছিলেন অবশ্যই। অনেক ছোট বেলায় আমি যখন গল্প-উপন্যাসের বই পড়া শুরু করি, তখন সেটা লুকিয়েই করতে হতো। বাবার ভয়ে অনেক সময় চালের ড্রামের মধ্যে বই লুকিয়ে রাখতাম। মা চাল নিতে গেলে টের পেতেন, কিন্তু কখনোই কিছু বলতেন না। আমার লেখক পরিচিতি যখন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লো, তখন বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশ নিচ্ছি। প্রত্যেকবার বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিতেন।

কতটা অসাম্প্রদায়িক ছিলেন তিনি?
মা খুব ধর্মচর্চা করতেন। আবার আপাদমস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন। তার মুখেই আমি প্রথম শুনেছি- মানুষকে হিন্দু-মুসলমান দিয়ে বিচার করো না। মানুষকে মানুষ হিসেবে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। মা নিজেও কখনো ধর্ম দিয়ে মানুষকে বিচার করেননি। মায়ের সেই অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা আমরা কোনোদিন ভুলিনি, ভুলবো না। আমি যতদিন বেঁচে আছি, মায়ের এই শিক্ষা নিয়েই বেঁচে আছি।

জোবেদা ওসমান মহিলা মাদরাসা সম্পর্কে জানতে চাই।
মায়ের মৃত্যুর আগেই মায়ের নামে এই মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করে আমার ভাই মাওলানা আবদুল্লাহ। নেত্রকোণাতে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এখান থেকে প্রতিবছর এক ঝাঁক মেয়েশিশু ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করে বের হচ্ছে। আমি মনে করি, তার একটা সাওয়াবের অংশ চলে যাচ্ছে আমার মায়ের কবরে। আমরা মায়ের নামের এই প্রতিষ্ঠানটিতে আরও ছড়িয়ে দিতে চাই। এখান থেকে বেরুনো ছোট্ট মেয়েশিশুরা সবাই একদিন আমার মায়ের মতো হবে, সেই স্বপ্ন দেখি।

তিনি হজ পালন করেছিলেন নিশ্চয়ই? 
মা হজ করেছেন দুবার। মক্কায় গিয়ে সন্তানদের জন্য আল্লাহর কাছে হাত তুলে কান্নাকাটি করতেন। হজ শেষে যেন নতুন মানুষ হয়ে ফিরে আসতেন মা। তার চোখ দেখে মনে হতো- অমূল্য কিছু একটা পেয়েছেন। তাকে সেটা জিজ্ঞাসা করলে মুচকি হেসে বলতেন, আল্লাহর ঘরে গিয়ে তোদের জন্য দোয়া করেছি। ক’জনেরই-বা এই সৌভাগ্য হয়, আমার তো হয়েছে। তাই আমি খুব খুশি। তোদের জন্য দোয়া করেছি। আল্লাহ তার ঘরের উসিলায় নিশ্চয়ই সেই দোয়া কবুল করবেন।

অতিথিপরায়ন হিসেবে কেমন ছিলেন তিনি? 
মেহমানদের খুব সম্মান করতেন মা। বাসায় যদি কোনো মেহমান আসতো, তাহলে সবচেয়ে উত্তম খাবারটা তাকে খাওয়াতেন। কখনো মেহমানের ওপর আমাদেরকে প্রাধান্য দিতে দেখিনি। আরেকটি বিষয় হলো- মেহমান মানে শুধু রক্তের সম্পর্কের কেউ কিংবা আত্মীয়-স্বজন হতে হবে- এমনটা মনে করতেন না তিনি। অপরিচিত একজন আগন্তুককেও তিনি মেহমান হিসেবে বিবেচনা করতেন এবং সাধ্য অনুযায়ী তাকে খেতে দিতেন, সেবা করতেন।

মায়ের কাছ থেকে শেখা কোন বিষয়গুলো আপনার জীবন চলার পাথেয়?
যদি এক কথায় বলতে যাই, মায়ের কাছ থেকে শিখেছি- শক্তি, সাহস, সততা, ভালোবাসা, প্রেমপ্রীতি আর আত্মবিশ^াস। পৃথিবীর কল্যাণে এই শব্দগুলো আমি মায়ের কাছ থেকে চয়ন করেছি। এগুলো আমি কখনোই ভুলবো না। আমি এখনো যে কার্যকরভাবে বেঁচে আছি, সেটা মায়ের ওই শিক্ষাগুলোর মধ্যেই আবর্তিত হয়েই। এভাবেই আমি বেঁচে থাকতে চাই।

মাদরাসা প্রাঙ্গনে মরহুমার কবর

তার কোন বিষয়টি আপনার মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে?
এখনো বিস্ময় নিয়ে ভাবি, আমার মা এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি সারাটা জীবন আমাদের জন্য উৎসর্গ করেছেন। তিনি কখনো বিশ্রাম নেননি কিংবা দুদÐ নিজের জন্য ভাবেননি। খুব ছোটবেলায় তার বিয়ে হয়েছে। তারপর ঘন ঘন বাচ্চা হয়েছে। কিন্তু তিনি থামতেন না। অসুস্থ বোধ করছেন বলে কখনো বসে থাকেননি। সংসার বড় হওয়ায় তার সার্বক্ষণিক চিন্তা ছিল- কোন সন্তানকে খাবার দিতে হবে, কার কখন কী প্রয়োজন। যখন বৃদ্ধ হয়েছেন, আমরা যে যার মতো আলাদা হয়েছি। তখনও তিনি থামেননি। সর্বক্ষণ ফোনে খোঁজ নিতেন। কোনো সমস্যা হলে বৃদ্ধ শরীরটাকে টেনে ঢাকায় চলে আসতেন। আমরা ভাই বোনরা যেন ছিলাম তার সাধনার অংশ। আমাদের জন্য তার ত্যাগের এই বিষয়টি মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে।

আলহাজ জোবেদা বেগমের মৃত্যু সম্পর্কে জানতে চাই।
২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। আমাদের সবাইকে ছেড়ে তিনি আল্লাহর কাছে চলে গেছেন। ঢাকার বারডেম হাসপাতালে ওইদিন সকালে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। সেই দিনটা আমি কখনোই ভুলবো না। অশ্রু যেন কোনো প্রকার বাঁধ মানছিল না। ভেজা চোখেই সেদিন মায়ের উদ্দেশ্যে রচনা করেছিলাম দীর্ঘ এক শোকগাঁথা। সবার কাছে আমি তার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।

মায়ের মৃত্যুবাষির্কীতে আপনার কী চাওয়া?
আমি লেখক মানুষ। অনেককে অনেক উপদেশ-পরামর্শ দিয়ে থাকি। সব নারীকে যদি আমার মায়ের মতো হতে বলতে পারতাম তাহলে ভালো হতো। কিন্তু সবাই তো আর আমার মায়ের ব্যাপারে জানেন না, তাই সেটা বলাও সম্ভব নয়। জীবনের এই ষাটোর্ধ্ব বয়সে এসে আমি নিজেকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করি, আমি কী হতে চাই। ভেতর থেকে আমার অবচেতন মন উত্তর দেয়- মায়ের মতো হতে চাই। মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমার স্পষ্ট চাওয়া- আমার মায়ের মতো পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চাই।


চ্যানেল ৭৮৬ এর নিউজ রুম এ যোগাযোগ করতে ই মেইল করুন এই ঠিকানায় [email protected] । আপনার পন্য বা সেবার প্রচারে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য কল করুন +1 (718) 355-9232 এই নাম্বারে।

সংবাদটি শেয়ার করুনঃ