যেন হরেক রঙের ঝরনাধারা, তার সঙ্গে শত শত শান্তির পাখি। এ নিয়ে শুরু হলো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন হিন্দু আধ্যাত্মিক সাধক শ্রী চিন্ময়ের শিল্পকর্মের প্রদর্শনী ‘আ লাইন অব লাইট’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে।
গতকাল শুক্রবার বিকেল চারটায় প্রদর্শনীর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছিল আয়োজক সংগঠক শ্রী চিন্ময় মেডিটেশন সেন্টার ঢাকার পরিচালক শান্তিশ্রীর অতিথিদের স্বাগত সম্ভাষণ ও শ্রী চিন্ময়ের কাজের পরিচিতি তুলে ধরার মধ্য দিয়ে।
অনুষ্ঠানে কোনো সভাপতি, প্রধান অতিথি বা আলোচক ছিলেন না। শান্তিশ্রী বলেন, অতিথিরাই এই প্রদর্শনীর প্রধান অতিথি। প্রদর্শনী ২২ জুন পর্যন্ত প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
প্রদর্শনীর ছবিগুলো মূল শিল্পকর্ম নয়। শ্রী চিন্ময়ের আঁকা ৫০টি ছবির ডিজিটাল প্রিন্ট নিয়ে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। শান্তির পাখিগুলো ছাড়া সব কাজই বিমূর্ত ধারার। কোনো অবয়ব বা বিশেষ কোনো আকৃতি নেই। সরু, মাঝারি, মোটা নানা রকম ব্রাশ বা তুলির আঁচড় টেনে, ছোপ দিয়ে, লেপ্টে দিয়ে রং লাগানো হয়েছে পটে। গেরুয়া, হলুদ, কমলা, লাল, নীল বা সবুজ এমন রঙেরই প্রাধান্য পেয়েছে অঙ্কনগুলোতে।
এ কাজগুলো সম্পর্কে শান্তিশ্রী বলেন, শ্রী চিন্ময় তাঁর এই শিল্পকলার নাম দিয়েছিলেন ‘ঝর্ণা-কলা’। এগুলো মূলত আধ্যাত্মিক চিত্রকলা। এর বিশেষ কোনো অর্থ নেই। পাহাড় থেকে যেমন জলপ্রবাহ গতিমান ঝরনা হয়ে নেমে আসে, এই ছবিগুলোতেও রেখা ও রঙের বর্ণালি একটা বর্ণাঢ্য গতিপ্রবাহ সৃষ্টি করে। সেই গতিময়তা ও বর্ণবৈভব দর্শকদের চিত্তে বিশেষ ধরনের আবেগ অনুভব সঞ্চার করে। সহজ কথায় ছবিগুলো অর্থবোধক নয়, হৃদয়াবেগ–সঞ্চারী।
আর শান্তির পাখিগুলো শ্রী চিন্ময় এঁকেছেন বিশ্বশান্তির প্রতীক হিসেবে। কোথাও আছে একক একটি পাখি। কোথাও আছে পাখির ঝাঁক। এ রকম প্রায় দেড় কোটি শান্তির পাখি এঁকেছেন শ্রী চিন্ময়। সব মিলিয়ে একক পট হিসেবে শ্রী চিন্ময়ের আঁকা এই ‘ঝর্ণা-কলা’ চিত্রকর্মের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার। তাঁর কাজ প্যারিসের বিখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়াম, জাতিসংঘ সদর দপ্তর, ইউনেসকো কার্যালয়, লন্ডনের ভিক্টোরিয়া মিউজিয়ামসহ বিশ্বের বিভিন্ন গ্যালারিতে সংগৃহীত হয়েছে।
আধ্যাত্মিক সাধক শ্রী চিন্ময়ের জন্ম চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় ১৯৩১ সালে। তাঁর পুরো নাম শ্রী চিন্ময় কুমার ঘোষ। তিনি ১২ বছর বয়সে বাবা-মাকে হারান। পরে ১৯৪৪ সালে ভারতের পদুচেরিতে চলে যান। সেখানে অরবিন্দ আশ্রমে তিনি দীর্ঘ ২০ বছর আধ্যাত্মিক সাধনার পাশাপাশি ধ্যান এবং বাংলা ও ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের শিক্ষা লাভ করেন। শ্রী চিন্ময় ১৯৬৪ সালে নিউইয়র্কে চলে যান। সেখানে তিনি যোগসাধনা শুরু করেন। পরে নিউইয়র্কের কুইন্স শহরে প্রথম মেডিটেশন সেন্টার গড়ে তোলেন। এখন বিশ্বের ৭১টি দেশে মেডিটেশন সেন্টারের শাখা রয়েছে ৩৬১টি।
শ্রী চিন্ময় যোগচর্চার পাশাপাশি লেখক, কবি, শিল্পী, সংগীতজ্ঞ এবং একজন ক্রীড়াবিদ হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর লেখা বাংলা গানের সংখ্যা ২১ হাজার এবং ইংরেজি গান প্রায় ৭ হাজার। শ্রী চিন্ময়ের বিভিন্ন দেশের ভক্ত সংগীতশিল্পীরা মিলে ‘গান্ধার্ব লোক অর্কেস্ট্রা’ নামের সংগীত দল গঠন করেছেন। ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র ২০০৯ সালে গান্ধার্ব লোক অর্কেস্ট্রা ও শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গানের সংগঠন সুরের ধারা যৌথভাবে রবীন্দ্রসংগীত ও শ্রী চিন্ময়ের গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল।
২০০৭ সালের ১১ অক্টোবর এই বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী আধ্যাত্মিক সাধক নিউইয়র্কে প্রয়াত হন, সমাহিত হয়েছেন সেখানেই। তিনি নেই, তবে এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে তাঁর কাজ এল তাঁর জন্মভূমিতে।